অভিজিতের মগজ এই দেশের নোংরা রাজপথে পড়ে ছিল অবহেলায়। সেই মগজের দায় আমাদের, এই মগজ আমরা আর অনেক চেষ্টাতেও পাব না। দেশটাকে অন্ধকারের প্রাণীদের অভয়ারণ্য হতে দিতে না চাইলে- এই মগজের দায় নিতে তৈরি থাকুন।

বিজ্ঞানের অনেক জটিল বিষয় বাংলায় সহজ করে লেখাটা কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার। একাডেমিক বইয়ের কথা বাদ দেই, সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দুর্বোধ্য বিষয় গুলো সহজ করে উপস্থাপন করাটা কঠিন একারণে যে, বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি হয়েছে খুব কম। একদিকে মানুষের মধ্যে পুঞ্জিভূত কুসংস্কার, শিক্ষার অপূর্ণতা, জটিল বিষয় বুঝতে চাওয়ার আগ্রহের অভাব- আর অন্যদিকে ভালো লেখকের অভাব, যিনি কিনা একই সাথে বিজ্ঞানও বোঝেন, আবার বাংলাটাও এতটাই ভালো জানেন যে জটিল বিষয় গুলো সহজ করে লিখতে কোন বেগ পেতে হয় না তাকে। 

আমাদের দেশে কিংবা বাংলা সাহিত্যে এমন লেখক খুবই দুর্লভ। এই দুর্লভদের মধ্যে আধুনিকতম যে মানুষটি অবলীলায় এই জটিল কাজটি সহজ ভাবে করে যাচ্ছিলেন, তিনি অভিজিৎ রায়। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাঁকে ধরে রাখতে পারিনি, আমাদের এই নরকে। 

বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, সিঙ্গাপুর থেকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স এবং ডক্টরেট করা অভিজিৎ রায় অন্য অনেকের মত, বলা চলে অন্য সকলের মতই বিদেশের মাটিতে ভালো বেতনে চাকরী করে, আরাম আয়েশের জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন কেবল। কেউ তাঁকে অভিসম্পাত করতো না। কিন্তু কিছু মানুষ থাকে, ঐ যে কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের? অভিজিৎ রায় ছিলেন তেমন একজন। নিজের ব্যক্তিগত ও কর্ম জীবনের পাশাপাশি তাঁর স্বপ্ন ছিল দেশের মানুষের জন্য কিছু করার, কুসংস্কারের অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই দেশটিকে নিজের জায়গা থেকে আলো বিলিয়ে যাওয়ার। 

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অন্ধকার দূর করা যায় একমাত্র আলো দিয়েই। তাই তিনি সেই কাজটিই শুরু করলেন। আমরা বাংলা ভাষায় পেলাম চমৎকার কিছু বই, যা আমাদের চিন্তা করতে শেখায়, ভাবতে শেখায়, নতুন করে জগৎটাকে দেখতে শেখায়। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘মুক্তমনা ব্লগ’- মুক্তচিন্তার মানুষদের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে মানুষ লিখবে, পড়বে এবং বলবে সে সব প্রথাবিরোধী বিষয় গুলো নিয়ে, যেগুলো বলার কোন সুস্থ পরিবেশ নেই এই দেশে। 

অভিজিৎ রায়

স্বাভাবিকভাবেই, তাঁর এই কাজ গুলো অন্ধকারের প্রাণীদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠেছিল। অন্ধকারের যাদের বাস, আলোকে তো তারা ভয় পাবেই। ধর্মান্ধ-জঙ্গি গোষ্ঠী তাই আলোর উৎসটিকেই তাদের লক্ষ্যে পরিণত করলো। অভিজিৎ রায়ের বহু মূল্যবান মগজ পড়ে রইলো বাংলার নোংরা রাজপথে। আমাদের দুর্ভাগ্য, অন্ধকারের প্রাণীরা সফল হলো। তাঁকে মেরে ফেলার মাধ্যমে নয়, আমাদের ভয় পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে। 

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর তাঁকে ঘিরে অনেকের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। খবর নিয়ে জেনেছিলাম মানুষজন অভিজিৎ রায়ের বই কিনছে দেদারসে। এভাবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম হচ্ছিল অভিজিৎ রায়ের। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের ‘অপরাধে’ যখন জাগৃতি প্রকাশনীর দীপনকেও ওরা হত্যা করলো, তখন আলোর শেষ বিন্দুটিও নিভে গেল যেন। জাগৃতির স্টলে কিংবা দীপনের স্মরণে নির্মিত দীপনপুরে এখন আর অভিজিতের বই পাওয়া যায় না। প্রকাশকরা ভয়ে নতুন করে ছাপায় না তাঁর বই। কাজেই অল্প কয়েকটি বই ছাড়া অভিজিৎ রায়ের বই গুলো আর বাজারে পাওয়া যায় না, ছাপার অক্ষরে। 

তবে অভিজিৎ রায়ের সর্বশেষ বই ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’ এবং ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বই দুটো এখনো পাওয়া যায়। কিন্তু ‘সমকামিতা’ এবং ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ এর মত অসাধারণ এবং অতি প্রয়োজনীয় বই গুলো পাওয়া যায় না। নাস্তিকতা বা বিজ্ঞানের বাইরেও তাঁর পাণ্ডিত্য এবং লেখকসত্ত্বার পরিচয় পাওয়া যায় ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো- এক রবি বিদেশিনী’ বই থেকে। যারা অভিজিৎ রায়ের বই পড়তে আগ্রহী তারা মুক্তমনা ব্লগ সাইটে গেলেই পিডিএফ আকারে বই গুলো পেয়ে যাবেন। 

মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু আইডিয়ার মৃত্যু নেই। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তাঁর কাজের, তাঁর সৃষ্টির মৃত্যু হয়নি। তাঁর কোন দরকার ছিল না বাংলায় দুর্বোধ্য বিষয় গুলো সহজ করে লেখার- লিখতে চাইলে তিনিও লিখতে পারতেন প্রেমের উপন্যাস। চাইলে ইংরেজি ভাষাতে লেখালেখি করতে পারতেন ভীনদেশে। কিংবা চাকরি-গবেষণা-পরিবার-সোসাইটি নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে পারতেন। তাহলে এবার বইমেলাতেও ঘুরতে আসতেন তিনি, যেমন এসেছিলেন সেবারও। পরিচিতদের সাথে আড্ডা দিতেন, সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতেন। কিংবা নিজের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনে বইমেলার টানে দেশে না আসলেও তো হত তাঁর, তাহলে আমরা এবারো হয়তো তাঁর একটা বই পেতাম। 

স্ত্রী বন্যা আহমেদের সঙ্গে অভিজিৎ রায়, একুশে বইমেলায়

হতে পারতো অনেক কিছুই। কিন্তু যেটা হয়েছে, সেটাই সত্য, মেনে নিতে কষ্ট হলেও। তিনি আমাদের হাতে যে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তাঁর অবহেলায় পড়ে থাকা মগজের সাথে সাথে, সেই দায়িত্ব পালন সহজ কাজ নয়। আরেকজন অভিজিৎ রায় আমরা কবে পাব? আমার জানা নেই। নাস্তিকতা, ধর্ম কিংবা বিজ্ঞান নিয়ে লেখে এমন অনেকেই আছেন। কিন্তু একই সাথে পাণ্ডিত্য, ভাষাজ্ঞান এবং বিশুদ্ধ চিন্তার যে সম্মিলন অভিজিতের মধ্যে ঘটেছিল, সেটা খুব সহজে আবার হবার নয়। আমরা এখন ভয়ে আচ্ছন্ন। এই সুযোগে দেশ পরিণত হচ্ছে অন্ধকারের পশুদের চারণভূমিতে। আমাদের সরকার, রাষ্ট্র, সমাজ তাদের বেড়ে উঠতে দিচ্ছে, তারা বেড়ে উঠছে আমাদেরই রক্ত শোষণ করে। ধর্মীয় কুসংস্কার, অজ্ঞতা, হিংস্রতা আমাদের অস্থিমজ্জা সংক্রমণ করে ফেলেছে। 

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর, একজন লেখকের মৃত্যুর পর হাতে গোণা দু একজন ছাড়া অধিকাংশ নপুংশ লেখক গর্তে লুকিয়ে ছিল। কয়েকজন লেখক নামধারীকে দেখেছি উল্লাস করতে, তাদের স্বস্তা বস্তাপচা প্রেমের উপন্যাস গুলোর একটা গতি হবে ভেবে! এই শ্বাপদসংকুল অরণ্যেই আমাদের বাস। এটাকেই আমাদের পরিষ্কার করতে হবে সর্বশক্তি দিয়ে। আমাদের বলতে হবে, লিখতে হবে। আর সে জন্য জানতে হবে, পড়তে হবে। ঘৃণার বাণী বা বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলে অন্ধকার দূর করা সম্ভব নয়। অভিজিৎ রায় ছিলেন আমাদের আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রী। আগে নিজের মধ্যকার আলোটুকু জ্বালানোর চেষ্টা করুন। এরপর অভিজিতের পথ ধরে সামনে এগোনো যাবে। 

অভিজিতের মগজ এই দেশের নোংরা রাজপথে পড়ে ছিল অবহেলায়। সেই মগজের দায় আমাদের, এই মগজ আমরা আর অনেক চেষ্টাতেও পাব না। দেশটাকে অন্ধকারের প্রাণীদের অভয়ারণ্য হতে দিতে না চাইলে- এই মগজের দায় নিতে তৈরি থাকুন।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা