অস্ট্রেলিয়ার জনগণ যেভাবে হারিয়ে দিয়েছে করোনাকে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

অস্ট্রেলিয়া আর আমি - দুইজনে মিলে একশো বছরের ইতিহাসে একটা মহামারী একসাথে কাটিয়ে দিয়েছি, তারপরেও বেঁচে আছি। আমি আর ভয় পাই না। আমি আর ভয় পাই না।
১৯ মার্চ, ২০২০। এগারো দিনের অস্ট্রেলিয়া টু নিউজিল্যান্ড ওশান ক্রুজ শেষ করে "রুবি প্রিন্সেস" নামে টাইটানিকের মতো একটা জাহাজ সিডনি সমুদ্র বন্দরে ফাইনাল নোঙ্গর ফেলে। সিডনিতে আসার আগে জাহাজটার লাস্ট স্টপেজ ছিলো নিউজিল্যান্ডের "নেপিয়ার" নামে একটা জায়গা। সেইখান থেকেই এই জাহাজের দুইজন যাত্রী আক্রান্ত হয় করোনা ভাইরাসে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে রুবি প্রিন্সেসকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো, ভাইরাস এটাক হয়েছে, যাত্রীদের সবাইকে যাতে আইসোলেট করে ফেলা হয়। সবাই যাতে নিজের কেবিনের মধ্যেই থাকে, অন্য কারো সাথে যাতে না মেশে।
জাহাজের কর্মকর্তারা এই নির্দেশনার ভয়াবহতা বুঝতে পারেনি। এইরকম স্ট্যান্ডার্ডের জাহাজে ক্রুজের একেকটা টিকেটের দাম চার-পাঁচ হাজার ডলার, মানুষ সারা জীবনের আনন্দ - ফাটিয়ে করতে এইসব ক্রুজে আসে। এদেরকে বঞ্চিত করার কোনো মানেই হয়না, ফলে তাদের আটকানোও গেলোনা।

সুইমিং পুল, ডাইনিং হল, ডান্স ফ্লোর, টয়লেট, কমন এরিয়া - সেই দুইজন রোগী, দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় একের পর এক যাত্রীকে আক্রান্ত করতে থাকলো। একজন থেকে আরেকজন, তার থেকে আরেকজন - এইরকম হতে হতে ফাইনাল ফিগার, দুই হাজার সাতশো যাত্রীর মধ্যে প্রায় ছয়শো সত্তুর জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলো।
অস্ট্রেলিয়া তখনও পর্যন্ত শুধু জানে, চীন থেকে আসা লোকজনকে এয়ারপোর্টে ঠেকাতে হবে। সেটাই তারা করে যাচ্ছে। এইদিকে যে চীনের ভাইরাস নিউজিল্যান্ড হয়ে জাহাজপথে অস্ট্রেলিয়াতে আসছে, সেই খবর তাদের কাছে ছিলোনা, ফলে সমুদ্রবন্দরে সেইরকম আইসোলেশনের ব্যবস্থাও ছিলোনা।
ফলাফল - রুবি প্রিন্সেস জাহাজের ছয়শো সত্তুর জন করোনা আক্রান্ত যাত্রী কোনো চেকিং ছাড়া অস্ট্রেলিয়াতে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা বাস, ট্রেন, প্লেনে করে মেলবোর্ন, এডিলেড, ক্যানবেরা, পার্থ - এসব জায়গায় যেতে থাকলো, আর করোনা ছড়াতে থাকলো, করোনা ছড়াতে থাকলো। অস্ট্রেলিয়ান সরকারের মিলিয়ন ডলার ফেইলিওর হিসাবে এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে - একটা জাহাজকে তারা জায়গামতো আটকায় ফেলতে পারে নাই।
সিচুয়েশন খারাপ হতে থাকায় মার্চের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়া লকডাউনে গেলো। মানুষজন চাকরি হারালো, ব্যবসাগুলো ধ্বসে পড়লো। ২০১৯ সালের শেষদিক থেকে ২০২০ সাল - অস্ট্রেলিয়া ফেইস করেছে স্মরণকালের বৃহত্তম দাবানল। শুরু হয়েছিলো দাবানল দিয়ে, দেশের বিশাল অংশের মহামূল্য বনভূমি এই ভয়াবহ দাবানলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে। এরপর আসলো বন্যা, কৃষিকে মোটামুটি ভাসিয়ে ফেলেছে এই বন্যা।
এরপর আসলো করোনা ভাইরাস। এইটাও যদি ক্ষতির সর্বোচ্চ মাত্রা দেখাতো, অস্ট্রেলিয়া হয়তো দেশ হিসাবে আর কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না। আজকে উন্নত দেশ হিসাবে অস্ট্রেলিয়াকে আপনারা চেনেন, পুরো দেশটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতো যদি করোনার ক্ষতির মাত্রাটা বেশি হতো।
থ্যাংকস টু অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ জনগণ। সরকার শুরুতেই বলে দিয়েছিলো, আমরা নিরুপায়, আমরা একের পর এক মারাত্মক সমস্যা ফেইস করছি, আমরা জানিনা - এগুলো আমরা কীভাবে মোকাবেলা করবো। আমরা আপনাদের সাহায্য চাই। এই হচ্ছে গাইডলাইন, এইসব কাজ করতে হবে আপনাদের - প্লিজ এগুলো করেন। না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। নিজে তো মরবেনই, আমরাও মরবো।
সাধারণ জনগণ কথাটা রেখেছিলো।
প্রায় পৌনে দুই মাসের লকডাউন, হাত ধোয়া, স্যানিটাইজিং, চাকরি হারানো, ব্যবসায়িক ক্ষতি, সরকারি সাহায্য - সবকিছুর ওপরে অস্ট্রেলিয়া যেটা দেখিয়েছে সেটা হচ্ছে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং। লকডাউনের মধ্যেও আমাদের সব রেস্টুরেন্ট খোলা ছিলো, সব সুপারমার্কেট খোলা ছিলো, সব শপিং মল অপারেটিং ছিলো, সব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলেছে। আমরা সব কিছুই করেছি - কিন্তু নিয়ম মেনে।
প্রত্যেকটা জায়গায় মানুষে মানুষে কঠোর দূরত্ব অবলম্বন করা হয়েছে। যেসব জায়গায় করা হয়নি, ব্লিচ দিয়ে ভিগোরাস ক্লিনিং করে সেসব জায়গাতেও সংক্রমণ ঠেকানো হয়েছে। মোটামুটি সবার চোখের আড়ালে পুরো দেশটাকে ধুয়ে ফেলা হয়েছে জীবাণুনাশক দিয়ে।
পৌনে দুই মাসে এই সবকিছু শেষ করে আজকে অস্ট্রেলিয়াতে লকডাউন ফাইনালি তুলে নেয়া হলো। সর্বোচ্চ দশজন মানুষের গ্যাদারিং এলাউ করা হয়েছে, একজন আরেকজনের বাসায় যেতে পারছে। স্কুল কলেজ কিছুদিনের মধ্যেই খুলে যাবে। এরপর একশোজন, এবং ক্রমান্বয়ে পাঁচশোজনের ইভেন্ট ওপেন হয়ে যাবে। অক্টোবর নাগাদ ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলও শুরু হয়ে যাবে।
সবচেয়ে বড় কথা, অস্ট্রেলিয়া গত প্রায় তিনদিন হলোঃ নিয়ারলি করোনা মুক্ত। নতুন কোনো কেইস ধরা পড়েনি, একজনও মারা যায়নি।
ভাবতেই ভালো লাগে, চোখের সামনে অন্য একটা দেশকে - সামান্য একটা জাহাজের ভুলের কারণে ধ্বসে যেতে দেখলাম, আবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে দেখলাম। জীবনটাই এরকম। আমরা ছোট ছোট ভুল করি, সেসব ভুলের কারণে ধ্বসে যাই, আবার উঠে দাঁড়াই। এভাবেই চলতে থাকে আমাদের জীবনচক্র।
আজকে গেছিলাম অস্ট্রেলিয়াকে ধ্বসিয়ে দেয়া, করোনা আক্রমণের সেই "রুবি প্রিন্সেস" জাহাজের নোঙ্গর বন্দরে। চুপচাপ তাকিয়ে ছিলাম বন্দরের দিকে, অনেকক্ষণ। শীত পড়েছে, সোয়েটার-টুপি পড়েও, সমুদ্রের দমকা ঠান্ডা হাওয়াতে নিজেকে সামলানো বেশ মুশকিলই হচ্ছিলো।
তারপরেও নীল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছি, "আয় শালারা, আয়। আমি আর ভয় পাইনা।" অস্ট্রেলিয়া আর আমি - দুইজনে মিলে একশো বছরের ইতিহাসে একটা মহামারী একসাথে কাটিয়ে দিয়েছি, তারপরেও বেঁচে আছি। আমি আর ভয় পাইনা।
ওরে জীবন,
আমি "সর্বশেষ" দেখে ফেলেছি।
আমি আর ভয় পাই না।
আমি আর ভয় পাই না।