এই মানুষটি যদি বিদেশের মাটিতে জন্মাতেন, গোটা জীবনের তাঁর কাজের পরিধির জন্যে তাকে নিয়ে প্রশংসাবাক্য লিখতো সবাই৷ অথচ এ দেশে তাঁর প্রয়াণকে কেন্দ্র করে উল্লাস করছে কিছু হিংস্র শ্বাপদ। কিন্তু তার কারণ?

বেশ কিছুদিন আগেই লিখেছিলাম আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের এ্যাসোসিয়েট জাস্টিস প্রয়াত রাথ ব্যাডের গিন্সবার্গ'কে নিয়ে। এই মানুষটির প্রয়াণে আমেরিকার সর্বস্তরের মানুষের দুঃখপ্রকাশের পাশাপাশি তাঁর স্মরণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও ছিলো দেখার মতন। গতকাল প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুঃখজনক হলেও আবিষ্কার করলাম, বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে এই মানুষটির মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ হওয়ার সাথেসাথেই সেখানে নোংরা ভাষায় উল্লাসে ফেটে পড়েছে কিছু মানুষ। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এর গোটা জীবনের কাজের যে বৈচিত্র্য ও গুরুত্ব, তা বিশ্লেষণ করলেও, তাকে নিয়ে শ্রদ্ধা হওয়া ছিলো অতলস্পর্শী। সেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার এই প্রয়াণে কেন কিছু পিশাচের এই উল্লাস, তা আমরা লেখার কোনো এক অংশে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। 

মাহবুবে আলমের জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে। পড়াশোনার প্রথম পাঠ শুরু করেন ঢাকায়। ঢাকার আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। ঢাকা কলেজ থেকে করেন এইচএসসি পাশ। এরপর তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করার পর তিনি পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স করেন। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পরবর্তীতে এলএলবি'তে মাস্টার্স করেন তিনি। ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

যুদ্ধের পরে তিনি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন।  এরপরে তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নথিভুক্ত আইনজীবী হন এবং আইনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হন। দুই বছর পরেই তিনি হাইকোর্টে প্রাকটিস শুরু করেন। পরবর্তীতে আপিল বিভাগের প্রাকটিসে যুক্ত হন তিনি। মাঝখানে পড়াশোনা করার জন্যে একবার চলে যান ভারতে। দিল্লির ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে সাংবিধানিক আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন। মাঝখানে একটা সময়ে বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলও ছিলেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হন। ২০০৯ সালের দিকে এসে তিনি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বপালন করা শুরু করেন। আমৃত্যু তিনি এই দায়িত্বেই ছিলেন। রাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তিনি সম্মুখসারির এক যোদ্ধা হয়েই লড়েছেন৷

এবার তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, এত অসাধারণ ও সম্মানজনক কর্মজীবন যে মানুষটির, সে মানুষটির মৃত্যুর পরে কিছু মানুষ (!) এর এত উল্লাসের কারণ কী? সে প্রশ্নের উত্তরে আসি এবার। মাহবুবে আলম তাঁর জীবদ্দশায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য সংবিধানের ৫ম, ৭ম ও ১৩তম, ১৬ তম সংশোধনী মামলা'র প্রধান কুশীলব ছিলেন। সংবিধান বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিলো ঈর্ষণীয়। এই হাইভোল্টেজ মামলার সময়ে তিনি যেন সেই জ্ঞানেরই সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। প্রত্যেকটা সংশোধনী, প্রত্যেকটা পয়েন্ট ধরে ধরে আর্গুমেন্টে তিনি প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়েছেন এবং শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষকেই জয়ী করিয়েছেন। এই ঘটনায় তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধী ও বঙ্গবন্ধু-বিরোধী কিছু মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন।

বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলার সময়েও তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। সেখানেও তিনি দুর্দান্ত বিশ্লেষণে অনেক কিছু তুলে এনেছিলেন জেরায়। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামী নিজামী, সাঈদী, কাদের মোল্লা, কামরুজ্জামান, মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ  অনেকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যেকটা মামলায় তিনি ছিলেন বাংলাদেশেরই প্রতিনিধি। রাজাকারদের প্রাপ্য দণ্ড নিশ্চিত যেন হয়, সেজন্যে এই শুভ্রচুলের মানুষটিকে বরাবরই দেখেছি আদালতের প্রাঙ্গণে, টিভিসেটের সামনে সাক্ষাৎকারে, পত্রিকার সংবাদে-কলামে। যুদ্ধাপরাধীদের মামলা পরিচালনায় তিনি এতটাই স্বচ্ছ ছিলেন, সাঈদী'র মামলার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার জন্যে তিনি নিজে পিরোজপুর গিয়েছিলেন। সরেজমিনে তদন্ত করেছেন সব। ঠিক এ কারণেই তিনি হয়ে গিয়েছেন এই সব যুদ্ধাপরাধীর চ্যালাদের চোখের বালি। এ কারণেই তাঁর প্রয়াণে দাঁতালো উল্লাস করতে পারছে কিছু মানসিক অপরিপক্ক প্রাণী।

যদিও যাবজ্জীবন যুক্ত ছিলেন তিনি আইনের মত কাঠখোট্টা বিষয়ের সাথে। কিন্তু ঘুরতেও খুব ভালোবাসতেন তিনি। যখনই কোথাও রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে হতো, ভেতরের 'পর্যটক' সত্ত্বা বের হয়ে আসতো তাঁর। অজস্র দেশ তিনি ভ্রমণ করেছেন এভাবে। এই তো ক'দিন আগেই তিনি হিমালয় হাইকিং এ গিয়েছিলেন। বয়স বাড়লে কী হয়! ভেতরে ভেতরে তিনি বরাবরই ছিলেন তরুণ। উর্দির নীচে বার্ধক্য আসার সুযোগটিই তাই আর পায় নি কোনোদিন। 

তিনি বরাবরই ছিলেন তরুণ মানসিকতার এক মানুষ! 

মাহবুবে আলমের প্রয়াণ আমাদের জন্যে এক অপূরণীয় ক্ষতি। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে এই মানুষটি যুক্ত ছিলেন আইনের সাথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের 'ব্রাণ্ড অ্যাম্বাসেডর।' তাঁর প্রয়াণে রাষ্ট্র কী উদ্যোগ নেবে জানা নেই আমাদের। তবে তাঁর প্রয়াণে হিংস্র শ্বাপদের আস্ফালন থেকে এটা খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, জীবদ্দশায় তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ যুক্তিবাদী জীবনই কাটিয়েছেন। আপোষ করেন নি কোনো অবিচারের সাথেই। তিনি হয়তো আর কোনো মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে আদালতে আসবেন না, কিন্তু প্রত্যেকটা মামলার সময়ে তাঁর দেয়া যুক্তি, তর্ক, বিশ্লেষণ নিয়ে গবেষণা, আলোচনা হবে আমৃত্যু। ঠিক এখানেই তাঁর চমৎকারিত্ব, সার্থকতা। 

এক দোর্দণ্ড পরাক্রমশালী আইনি-জীবন কাটানোর পর যে প্রয়াণ, সে প্রয়াণ গৌরবের-তৃপ্তির-সম্মানের। তাঁর প্রয়াণে তাই বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন 

​​​


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা