আশফাক নিপুণ: নির্মাণের সাহসিকতা যাকে স্বতন্ত্র ও অনন্য করে তুলেছে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
প্রশ্নফাঁস, গুম, গুজব থেকে শুরু করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, যৌন হয়রানি- এসব সমস্যা আমাদের জীবন যাত্রাকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল। আর এই সমস্যাগুলোকেই সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরেছেন এই নির্মাতা...
দ্বন্ধ সমাস, ফেরার পথ নেই,সোনালী ডানার চিল, এই শহরে ও ভিকটিম- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের নাট্যঙ্গনে অন্যতম আলোচিত নাম। এই সময়গুলোতে নাট্যঙ্গন যেমন অস্থির সময়ে কেটেছে তেমনি বেশ সংখ্যক নাটক দর্শকদের তৃপ্তি দিয়েছে। তবে সেই কাজগুলোর ভিড়ে এই পাঁচটি নির্মাণই স্বাতন্ত্র্যভাবে স্থান করে নিয়েছে।
এই নির্মাণগুলোতে ফুটে এসেছে সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্ররুপ। প্রশ্নফাঁস, গুম, গুজব থেকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, যৌন হয়রানি এই সমস্যাগুলো আমাদের জীবন যাত্রায় অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল, আর এই সমস্যাগুলোই সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরেছেন এক নির্মাতা। পাঁচটির নির্মাতা একজনই, যে রাঘব বোয়ালদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই সাহসী নির্মাণ করেছেন। দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে এই নাটকগুলো গ্রহণ করেছেন, খেতাব দিয়েছেন সময়ের সেরা সাহসী নির্মাতা। তিনি এই মুহুর্তে বাংলা নাটকের সবচেয়ে আলোচিত, প্রশংসিত নির্মাতা 'আশফাক নিপুণ'।
আজকাল অনেক নির্মাতারই ওজন ভার নির্ণয় করা হয় ইউটিউব ভিউ দিয়ে, সেখানে কিছু সংখ্যক নির্মাতা থাকে তাদের নির্মাণে ভিউ মুখ্য বিষয় তো নয়ই, কেউ সেটা হিসেবেও আনে না। আশফাক নিপুণ তেমনি একজন নির্মাতা, উৎসব এলেই দর্শকরা অপেক্ষা থাকে উনার নির্মাণের নাটক দেখার জন্য।
আমাদের নাট্যঙ্গনকে সমৃদ্ধ করার পিছনে ছবিয়াল বেশ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন৷ গুরু মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবিয়ালের শিষ্য হয়ে অনেক তরুণ তুর্কিই নাট্যনির্মাণে এসেছেন। আশফাক নিপুণের শুরুটাও সেভাবেই। এরপর তো নিজেকে নন্দিত করার পালা, সেটায় তিনি সফল, আশা করা যায় সামনে আরো করবেন।
নির্মাতা হিসেবে প্রথম নাটক 'মা-য়া', তবে দুঃখের বিষয় এই নাটকটি কোথাও আর পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় নাটক 'টু ইন ওয়ান', তবে আলোচনায় আসেন তাহসান-মিথিলা কে নিয়ে নির্মিত নাটক 'মধুরেণ সপায়েৎ' দিয়ে। বিজ্ঞাপনে আগে দেখা গেলেও এই জুটির শুরু এই নাটক দিয়ে৷ তখন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল৷ তাহসান-মিথিলা কে নিয়ে বেশ বিরতি নিয়ে একে একে নির্মাণ করেন ল্যান্ডফোনের দিনগুলিতে প্রেম, সে এবং সে, সুখের ছাড়পত্রের মতো নাটক।
দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা পার্থ বড়ুয়া ও অপি করিম কে নিয়ে অবাক ভালোবাসায় ও খুঁটিনাটি খুনসুঁটি নাটক নির্মাণ করে দর্শকপ্রিয় জুটি বানিয়েছেন৷ দর্শকরা এখনো ঈদ এলেই এই ত্রয়ী জুটির নাটক দেখতে চান৷ পার্থ বড়ুয়াকেই আবার ভিন্নরুপে এনেছিলেন 'ডাকাতিয়া বাঁশি' টেলিফিল্মে। নন্দিত অভিনেত্রী অপি করিমকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন 'কানামাছি ভোঁ ভোঁ'র মানসিক প্রতিবন্ধী, ভিকটিমের মাহা থেকে মিস শিউলির মতো প্রানবন্ত চরিত্রে। ঈশিতা খুব একটা অভিনয় করেন না, তবে আশফাক নিপুণের 'ইতি,মা' র মায়াময় বড় বোনের চরিত্র পেয়ে ঠিকই লুফে নিয়েছিলেন,আর স্বাভাবিকভাবেই পেয়েছেন তুমুল প্রশংসা।
২০১৭ সালে ছবিয়াল রিইউনিয়ন ও আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজ উৎসব হয়েছিল, তিনিই একমাত্র নির্মাতা, দুইটি উৎসবেই যার নাটক ছিল। ছবিয়াল উৎসবে হালকা মেজাজের নাটক 'ছেলেটা কিন্তু ভালো ছিল' অনেকেই পছন্দ করেনি৷ অন্যদিকে আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজে 'দ্বন্ধ সমাস' নির্মাণ করে দারুন প্রশংসিত হয়েছিল। ধর্মীয় রহস্যজাল ভেঙ্গে দেওয়া এই নাটকের মূলভাব প্রথমেই অনেকে বুঝতে পারেনি, আমিও না। অতি সাধারণ মনে হচ্ছিল। তবে পরবর্তীতে আবার দেখায় বুঝলাম সত্যিকার অর্থেই সাধারন ছাপিয়ে অসাধারণ হয়ে উঠেছিল। এই নাটকের জন্য প্রথমবারের মতো মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
২০১৮ সালে সামাজিক বার্তা নিয়ে এসেছিলেন ফেরার পথ নেই, সোনালী ডানার চিল ও কানামাছি ভোঁ ভোঁ নাটক দিয়ে, তিনটিই প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিল। এইগুলোর কারণে যখন তিনি হয়ে উঠেছেন দুঃসাহসিক নির্মাতা, ঠিক তখনই রোমান্টিক নাটক 'লায়লা, তুমি কি আমাকে মিস করো', বা তারুণ্য অনুপ্রেরণাকারী 'চাকা' নির্মাণ করে দিয়েছেন ভিন্নতার স্বাদ। বেশ কয়েক বছর আগেও তিনি সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নাটক 'ফাঁদ ফোকর' বানিয়ে, তবে এই নাটকে বেশিরভাগ দর্শকদের কাছে অগোচরে থাকায় অনালোচিত থেকে গেছে।
বাংলাদেশের টিভি জগতে সমকামিতা নিয়ে নাটক বানানো দুঃসাহসিক কাজ, এ নিয়ে 'রেইনবো' নামে নাটক বানিয়েছিলেন। গুনগত মান নিয়ে কথা উঠতে পারে তবে আশ্চর্যজনক ভাবে নাটকটি কিছু অতি উৎসাহী দর্শকদের চাপে ইউটিউব থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
গত বছর 'মিস শিউলি' টেলিফিল্মটি ছিল স্বস্তির নিঃশ্বাস। কৌতুকাবহের নাটক নির্মাণ করে নিজের পুরনো আবহ ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। 'এই শহরে' টেলিফিল্মটি দর্শকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে, সাম্প্রতিক সময়ে যে মানবহত্যার গুজব রটেছিল সেটার মূল বক্তব্য নিয়ে নির্মিত ছিল এটি, অন্য আরেকটি নাটক ছিল সামাজিক অবক্ষয়ের নমুনা ধর্ষণ নিয়ে নাটক 'আগুন্তক'।
এই বছর নিজেকে আরো স্বাতন্ত্র্য ও অনন্য করেছেন আশফাক নিপুণ। বছরের শুরুতেই ভালোবাসা দিবসে তাহসান ও তিশাকে নিয়ে 'মুখ ও মুখোশের গল্প' নামক নাটক বানিয়ে দর্শকদের চমকপ্রদ করেছেন। সদ্য শেষ হওয়া ঈদ উল আযহায় ভিকটিম, অযান্ত্রিক ও ইতি,মা নির্মাণ করে সেরা আলোচিত নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ইতি, মা ছিল এই ঈদের সবচেয়ে আলোচিত কাজ, অযান্ত্রিকে দেখিয়েছেন করোনাকালীন এক প্রবীণ শিক্ষকের গল্প, যেখানে সোলাইমান খোকার মতো অনালোচিত প্রবীণ অভিনেতাকে প্রধান চরিত্রে নির্বাচন করেছেন। আর 'ভিকটিম' এর গল্প সাম্প্রতিক কালের মি-টু আন্দোলন!
সময়ের সেরা জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীনকে সবচেয়ে ভালো ব্যবহার করতে পারেন তিনি। আশফাক নিপুণের নাটকে সত্যিই ভিন্ন মেহজাবীনকে পাওয়া যায়৷ সেটা 'তুমি না থাকলে' হউক কিংবা 'ফেরার পথ নেই এই শহরে'র মতো কাজে। আশফাক নিপুণের নাটকে অভিনয়ের কারণে শত সমালোচনার মাঝেও আফরান নিশো দর্শকদের কাছ থেকে প্রশংসা আদায় করে নেন যার প্রমাণ 'ও রাধা ও কৃষ্ণ', 'সাহেব মেমসাহেব' থেকে 'লায়লা তুমি কি আমাকে মিস করো', 'ইতি,মা' পর্যন্ত।
তিশা, ইরেশ যাকের তো বটেই, ইয়াশ রোহান, সাফা কবির, সাবিলা নূর- সবার থেকে প্রানবন্ত অভিনয় আদায় করে নেন তিনি। অভিযোগ অবশ্য আছে তিনি আবির মির্জাকে প্রতিভার তুলনায় বেশি সুযোগ দিয়েছেন। তবে তাঁর 'আল্পনা কাজল' নাটকে আবির মির্জার অভিনয় সবাই প্রশংসা করেছিল৷
এক সময় স্ত্রী এলিটা করিমের গান তাঁর নাটকে থাকবেই এটাই ছিল স্বাভাবিক, তবে এখন নাটকের ধারা পরিবর্তন হওয়ায় আগের মতো নেই। এলিটা করিম ও আবির মির্জাকে নিয়ে অসম প্রেমের নাটক বানিয়েছিলেন 'হোয়াই সো সিরিয়াস'।
ছবিয়ালের নাটকের পুরনো নির্যাস এখনো উনার নাটকেই পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত শুধু একটিই ধারাবাহিক নাটক বানিয়েছেন নাম 'মুকিম ব্রার্দাস', এটিও বেশ আলোচিত। শুধু নির্মাণে নয়, অভিনয়টাও তিনি ভালো করেন সেটার প্রমাণ মিলে উপসংহার, মিডলক্লাস সেন্টিমেন্ট নাটকে।
নাট্যজগতে সফল পদচারণার পর দর্শকরা মুখিয়ে আছেন সিনেমার নির্মাণের দিকে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সামনের বছরেই বানাবেন প্রথম সিনেমা 'গোল্লা'। প্রত্যাশা রইলো ভবিষ্যতের দিনগুলিতে উজ্জ্বল থেকে আরো উজ্জ্বলতর হবেন এই নির্মাণের মুন্সিয়ানায়।
আরও পড়ুন-