আসারাম বাপু: ধর্মের চাদর গায়ে জড়ানো এক ধর্ষকের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নিজের আশ্রমে ষোল বছরের কিশোরীর ওপরে যৌন নির্যাতন চালিয়েছিলেন আসারাম। দেশে-বিদেশে চারশোর বেশী আশ্রম আছে তার, সম্পত্তির মূল্য প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা! মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে ধর্মের ভেক ধরেই এই টাকার পাহাড় গড়েছে আসারামের মতো ধর্মব্যবসায়ীরা।
ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন আসামীর কাঠগড়ায়। বিচারক প্রবেশ করলেন এজলাসে, উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে গেল, এটাই তো নিয়ম। কিন্ত সেই বিচারক নিজে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন অভিযুক্ত ব্যক্তির সামনে, হাত ধরে চুমু খেলেন, চরণ স্পর্শ করে নিলেন পদধুলি! আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাদা দাড়িগোঁফে ঢাকা লোকটা সেই বিচারকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, যেন প্রিয় শিষ্যকে আশীর্বাদ করছেন গুরু!
এমনই অদ্ভুত একটা দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল কয়েক বছর আগে, ভারতের রাজস্থানের যোধপুরে। ধর্ষণের দায়ে কথিত এক ধর্মগুরু আসারাম বাপুর বিচারকাজ চলার সময় এভাবেই আদালতের ভেতরে তার সামনে মাথা ঠেকিয়েছিলেন এক বিচারক। এটা নিয়ে সেই সময়ে কম জলঘোলা হয়নি। সেই বিচারককে বিচারকার্য থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল, করা হয়েছিল তিরস্কার। আদালত এই ঘটনাটাকে সুস্পষ্টভাবে আসামীর প্রতি বিচারকের পক্ষপাতিত্ব বলেই রায় দিয়েছিল তখন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই আসারাম বাপু? কেন তার এমন প্রভাব? সোয়াশো কোটি মানুষের দেশ ভারত। মানুষের যেমন অভাব নেই, তেমনই অভাব নেই ধর্মেরও। এক হিন্দু ধর্মেরই হাজারটা রকম আছে এখানে। একেক সম্প্রদায়ের মানুষ একেক রকমের মতাদর্শ মেনে চলে। ধর্ম আর ধর্ম পালন করা মানুষের অভাব না থাকায়, সেখানে ধর্মগুরুরও কোন অভাব নেই। এদের বেশীরবাগই ধান্দাবাজ, ঠগ টাইপের লোকজন। নয়ছয় বুঝ দিয়ে ধর্মের ধ্বজ্জ্বাধারী সেজে থাকে।
কেউ কেউ ধরা পড়ে, বেশীরভাগই কখনও ধরা পড়ে না, সাধু-সন্ত সেজে কাটিয়ে দেয় পুরোটা জীবন। আসারাম বাপুও এমনই একজন। রাজস্থানের যোধপুরের কাছে মানাই নামের একটা এলাকায় ছিল তার আশ্রম। হাজার হাজার ভক্ত তার, সেই তালিকায় আছেন রাজ্য আর দেশের হোমরা-চোমরা ব্যক্তিরাও। উত্তরপ্রদেশের এক কিশোরী তার আশ্রমে শিষ্যা হিসেবে এসেছিল। এমন অনেক কিশোরী বা তরুণীই আশ্রমের সেবিকা হিসেবে কাজ করতো।
গোলমালটা বাঁধলো তখনই, যখন সেই কিশোরীর পরিবার আসারামের বিরুদ্ধে ধর্ষনের মামলা ঠুকে দিল কোর্টে। নিজের আশ্রমে ষোল বছরের সেই কিশোরীর ওপরে যৌন নির্যাতন চালিয়েছিলেন আসারাম- এমনটাই ছিল অভিযোগ। 'অশুভ প্রেতাত্মার সংস্পর্শ' থেকে বাঁচতে হলে গুরুদেবের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে হবে- এরকমটা জানিয়ে সেই কিশোরীকে জোর করেই আসারামের কাছে পাঠিয়েছিল আশ্রমের প্রধান সেবিকা।
ঘটনাটা ঘটেছিল ২০১৩ সালে। সত্তরোর্ধ্ব আসারাম তখন ভারতের শীর্ষ ধর্মগুরুদের একজন। বয়সটা বেশী হওয়াতে অন্য অনেকের চেয়ে আসারামের প্রভাবও বেশী ছিল। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শুনে চোখ কপালে উঠেছিল সবার। বিষয়টা প্রচণ্ড সংবেদনশীল, একারণে মামলে নিতে রাজী হয়নি থানা। পরে কোর্টে মামলা করা হলে পুলিশ বাধ্য হয় তদন্তে নামতে। পুলিশ বাহিনীতেও তার অনুগত ভক্ত ছিল অনেক।
আসারামের আশ্রমে বেশ কয়েকবার গিয়েছিল পুলিশ, তার সঙ্গে কথা বলতে, কিন্ত সে পুলিশের সামনে আসেনি। কোর্ট তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে রাজস্থান থেকে আসারাম চলে গিয়েছিল মধ্যপ্রদেশে। সেখানে তখন বিজেপির সরকার, কেন্দ্রে তখনও কংগ্রেস ক্ষমতায়। বিজেপির নেতাদের সঙ্গে আসারামের যোগাযোগ ছিল ভালো। এই অভিযোগ ওঠার পরে আসারামের পক্ষেই কথা বলছিলেন বিজেপির নেতারা।
রাজস্থানের পুলিশ তাকে ধরতে ধাওয়া করেছিল মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত। এত সহজে কি আর তাকে ধরা যায়? হাজারো ভক্ত তার আস্তানার সামনে ব্যারিকেড দিয়ে বসেছিল। সেই বাধা ডিঙিয়ে পুলিশও তার কাছে পৌঁছুতে পারছিল না। শেষে দাঙ্গা পুলিশ ডেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়, তার এক ভক্ত নিহত হয় পুলিশের সেই অভিযানে।
বিচারকাজ শুরু হবার পরেই বোঝা গেল, আসারাম বাপুর ক্ষমতা কতদূর বিস্তৃত। গ্রেফতার হবার দুইমাসের মাথায় আসারাম আর তার ছেলের বিরুদ্ধে গুজরাটের দুই বোন ধর্ষণের মামলা করেছিল। গুজরাটেও আসারামের আশ্রম ছিল, সেখানেই এই দুই বোনকে যৌন নিগ্রহ করা হয়। পুলিশ এই অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়ে আসারামের ছেলেকেও গ্রেফতার করে। কট্টরপন্থী ধর্মীয় আর রাজনৈতিক নেতারা তখন আসারামের মুক্তির দাবীতে একের পর এক আল্টিমেটাম দিচ্ছেন।
রাজপথে মিছিল বেরুচ্ছে আসারামের সমর্থনে। ওদিকে আসারামের বিরুদ্ধে তখন একে একে মুখ খুলছেন আশ্রমের সেবায়েত বা আসারামের অপকর্মের সাক্ষী হওয়া লোকজন। কিন্ত তারা বুঝতে পারেননি, কেউটের লেজে পা দিতে যাচ্ছেন! দুটো মামলায় মোট বিশজনেরও বেশী মানুষ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে নয়জনের ওপর প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়েছে 'অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্ত'রা।
এই দুর্বৃত্ত কারা, সেটা বলে না দিলেও চলছে। এরমধ্যে তিনজন সাক্ষী খুন হয়েছেন। নাবালিকা ধর্ষণ মামলার প্রধান যে সাক্ষী ছিলেন, তার নাম ছিল অখিল গুপ্ত। আশ্রমে আসারামের বাবুর্চি ছিলেন এই লোক। আদালতে আসারামের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন অখিল, এই অপরাধে তাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিয়েছিল আসারামের চ্যালারা। স্কুটারে করে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুটো মোটরসাইকেলে করে আসা আরোহীরা তাকে গুলি করে। হাসপাতালে নেয়ার আগেই মৃত্যু হয় অখিলের।
এর আগে গুজরাটে আরেক সাক্ষী অম্রুত প্রজাপতি খুন হয়েছিলেন। আরেক সাক্ষী মারা গিয়েছিলেন বাসচাপায়, সেটাও খুন বলেই ধারণা করেছিল পুলিশ। আর নির্যাতিতার পরিবারকে যে মামলা তুলে নেয়ার জন্যে কত প্রলোভন আর হুমকি ধামকি দেয়া হয়েছে, তার তো ইয়ত্তা নেই কোন! তবুও তারা পিছু হটে যায়নি।
এরমধ্যেই ঘটেছে বিচারকের কুর্ণিশ করার কাণ্ডটা। রাজস্থানের একটা অঞ্চলের তৃতীয় শ্রেণীর বাচ্চাদের পাঠ্যবইতে স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ বা মাদার তেরেসার পাশে মহামানব হিসেবে শোভা পেয়েছে আসারামের জীবনীও! বাচ্চাদের সেগুলো পড়ানোও হয়েছে কিছুদিন। মিডিয়াতে খবর আসার পরে তড়িঘড়ি করে বই পাল্টে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। আসারামের এমন দাপুটে চলনবলনের ফলে মামলার রায় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই।
তার ওপর ভারতের সরকারে এখন বিজেপি, কট্টরপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী এই দলটার নেতাদের অনেকের সঙ্গেই তো আসারামের সুসম্পর্ক রয়েছে। মামলার রায় ঘোষণার জন্যে আদালতের পরিবর্তে বেছে নেয়া হয়েছিল জেলগেটকে। কোনরকমের সহিংসতা যাতে না ঘটে, সেজন্যে পুরো রাজস্থানজুড়ে নেয়া হয়েছিল কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা।
রাজস্থানের বাইরে গুজরাট বা হরিয়ানার যেসব জায়গায় আসারাম বাপুর আশ্রম ছিল, সেখানে পুলিশ মোতায়েন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারগুলোকে। পুলিশ ঘিরে রেখেছিল উত্তরপ্রদেশে নির্যাতিতা সেই কিশোরীর বাড়িটাও। যদিও সেই বাড়ি ছেড়ে নিরাপত্তাজনিত কারনে তার পরিবার মামলা করার পরপরই দিল্লিতে পাড়ি জমিয়েছিল। মামলা চলাকালীন সময়ে গত পাঁচ বছরে বারো বার জামিনের আবেদন করেছিল আসারাম, প্রতিবারই নাকচ করা হয়েছে আবেদন।
এর কিছুদিন আগে যখন এমনই আরেক ধর্মগুরু গুরমিত রাম-রহিম সিং-এর সাজার রায় দেয়া হয়েছিল, তখন পুলিশের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছিল তার ভক্তদের। ছত্রিশ ভক্ত নিহত হয়েছিল সেবার, ভাংচুর করা হয়েছিল সরকারী অফিস-আদালত। সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই আসারাম বাপুর মামলার রায় ঘোষণার সময় নিরাপত্তায় কোন ফাঁক রাখেনি পুলিশ। পুরো যোধপুর শহরটাকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে যেন দুর্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল সেদিন।
সপ্তাহব্যাপী ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছিল শহরে। আসারামের হোমরা চোমরা ভক্ত যারা ছিলেন, তাদের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছিল রায় ঘোষণার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। কোন রকমের বিশৃঙখলা ঘটে দিতে রাজী ছিল না রাজস্থানের পুলিশ বিভাগ। এবছরের পঁচিশে এপ্রিল দুপুর নাগাদ সেই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের মামলায় আসারামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজায় দণ্ডিত করলো আদালত।
পাঁচ অভিযুক্তের মধ্যে দুজনকে বিশ বছর করে কারাবাসের সাজা দেয়া হয়েছে, অন্য দুজন পেয়েছেন বেকসুর খালাস। গুজরাটে আরেকটা মামলা চলছে আসারাম আর তার ছেলের বিরুদ্ধে, দুই বোনকে ধর্ষণের দায়ে, সেটার রায়ও হয়তো দেয়া হবে খুব শীঘ্রই। ভারত আর ভারতের বাইরে মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ ভক্ত আসারামের, এই মানুষগুলো আসারামকে ডাকতো 'গডম্যান' বলে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো তাকে। কেউ কেউ হয়তো এখনও করে।
দেশে-বিদেশে চারশোর বেশী আশ্রম আছে তার, সম্পত্তির মূল্য প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা! মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে ধর্মের ভেক ধরেই এই টাকার পাহাড় গড়েছে আসারামের মতো ধর্মব্যবসায়ীরা। ধর্মের চেয়ে বড় ব্যবসা পৃথিবীতে আর কিছু নেই, সেটা আসারাম বা গুরমিত রাম রহিম সিং- এর মতো ধর্মের চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকা এই ভণ্ড লোকগুলোকে দেখলে আর তাদের কাণ্ডকীর্তি শুনলেই বিশ্বাস হয়।
তথ্যসূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ওয়ান ইন্ডিয়া ডটকম, হিন্দুস্তান টাইমস।