চারপাশে যখন সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষবাস্প, ধর্মের নামে মানুষের মানুষে ভেদাভেদের সুর- তখন আসানসোলের একটি গ্রাম দেখালো চমক। এলাকার একমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষটির মৃত্যুর পরে এলাকাবাসী মুসলমানরা মিলে আয়োজন করলো হিন্দু ধর্ম-মতে তার সৎকারের!

ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ায়ের সেই বিখ্যাত লাইনটি দিয়েই শুরু করি-

হয়তো তোমার সাথে আমার মতের মিল হবে না। কিন্তু আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও তোমার কথা বলার অধিকারকে রক্ষা করার চেষ্টা করবো।

অর্থাৎ, বিষয়টি খুব সোজা। সবাই একই চোখে যেহেতু সবকিছুকে দেখছে না, তাই নিজের মতামতের সাথে অন্যের মতামত না মিললেই প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়া মোটেও মানুষ-সুলভ কাজ নয়। বরং ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করে নিজের মতামত টা প্রকাশ করাটাই আসল। কথাবার্তা অথবা বিতর্কের সৌন্দর্য এখানেই। যে সৌন্দর্যের চর্চা, এই উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষজনই, করিনি আমরা কোনোদিনই।

আমাদের বহু বিষয়ে নানামত। ধর্ম, রাজনীতি, দর্শন, খেলাধুলা ছাপিয়ে সেগুলো মাঝেমধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ছোটখাটো বিষয়েও। অন্যের মতকে শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, ভিন্নমতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মাটির সাথে মিশিয়ে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ঠিক শান্তি পাই না। আবার সেটা যদি হয় ধর্মসংক্রান্ত মতবিরোধ, তাহলে তো কথাই নেই। খুনোখুনি, মারামারি, রক্তগঙ্গা পর্যন্ত বয়ে যেতে পারে। ইতিহাস সেটার সাক্ষ্য দেবে অজস্র উদাহরণে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এই উপমহাদেশ তো আর কম দেখলো না। এখনও 'পান থেকে চুন' খসলেই দেখা যায় আমাদের সাম্প্রদায়িক দাঁতালো অবয়ব।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় এ উপমহাদেশ বিপর্যস্ত হয় মাঝেমধ্যেই! 

ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি, ব্যবসা, খুন, রাহাজানি সবই হচ্ছে আজকাল। ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির হচ্ছে, গরু-খাওয়া নিয়ে খুন-জখমের ঘটনা ঘটছে।   বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সময়ে প্রতিমা ভাংচুর হচ্ছে, মিথ্যে গুজব রটিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে হিন্দুরা নিয়মিত ব্যবধানে দেশ ছেড়েছেন। ভারতের মুসলিমদেরও মাঝেমধ্যেই দেয়া হচ্ছে দেশ ছাড়ার হুমকি। দুই দেশেই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে বিষিয়ে উঠছে জনপদ। দাঙ্গা, কট্টরপন্থীদের আস্ফালন, ধর্মীয় উস্কানি...এসব তো আছেই।  আবার এরকম শ্বাসরুদ্ধকর বিক্ষুব্ধ সময়েও দুয়েকটি ভালো ঘটনার খোঁজও আমরা পাই।  যেখানে ধর্ম, অধর্ম, হিন্দু, মুসলিম ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে মানবিকতা।

পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের জামুরিয়া থানার দেশেরমোহন গ্রামে অনেকগুলো পরিবারের মধ্যে ছিলো একটিমাত্র হিন্দু পরিবার। শনিবার রাতে সেই পরিবারের বৃদ্ধ কর্তা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ মৃত্যুর খবর জানতে পেরে গ্রামের মুসলিম প্রতিবেশিরা রাতেই ছুটে আসেন সেই বাড়িতে। বাড়িতে সদ্যপ্রয়াত ব্যক্তির ছেলেমেয়ে কেউ ছিলো না। তাদেরকে রাতেই খবর দেন প্রতিবেশিরা। ছেলেমেয়ে আসতে আসতে মৃতদেহ পঁচে যেতে পারে, একারনে প্রতিবেশিরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে মরদেহ'কে হিন্দু ধর্মমতে সৎকারের ব্যবস্থা করেন। গল্পে একটুখানি বাড়তি অংশ আছে। এই হিন্দু ব্যক্তির জীবদ্দশায় চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছিলেন মুসলিম প্রতিবেশিরা৷ পাশে দাঁড়িয়েছেন, যখনই পেরেছেন।

দেশেরমোহন গ্রামের অসাম্প্রদায়িক মেলবন্ধনের এ ঘটনা সবাইকে চমকে দিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক মানুষদের কিছুটা হলেও তৃপ্তি দিয়েছে। এ রকমের ঘটনাগুলো আমাদের সাময়িক শান্তি দেবে। হয়তো আরো অজস্র ঘটনার ভীড়ে আমরা একসময়ে এই ঘটনা ভুলে যাবো। হয়তো সাম্প্রদায়িক সহিংসতাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা।  অসাম্প্রদায়িক প্রীতিই বরং বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন কিছু। তবু এরকম ঘটনাগুলোই আমাদের টালমাটাল সময়ের খুঁটি, খানিকটা হলেও ভরসার বাতিঘর। 'সাম্প্রদায়িকতা'র যে উত্তাল স্রোতে আমরা ভেসে যাচ্ছি, সেখানে এই ঘটনাগুলোই 'খড়কুটো' হয়ে আমাদের অবলম্বন।

এই প্রলয়ঙ্কর মহামারিতে এটুকু প্রাপ্তিও বা খারাপ কী!
 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন




 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা