অতি সম্প্রতি আমি বাংলাদেশে ধারণকৃত কয়েকটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে নানা রকম নেতিবাচক সমালোচনা দেখতে পেয়েছি...

আব্দুন নূর তুষারশ্লীলতা ও অশ্লীলতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। যেমন মিকেলাঞ্জেলো ডেভিড এবং জিসাস এর নগ্ন দেহের ভাস্কর্য খোঁদাই করেছিলেন। রদ্যাঁ, দোনাতেলো এরাও বহু নারী ও পুরষের নগ্নমূর্তি তৈরী করেছেন। এমনকি পুরুষের দেহে নারীর বক্ষ খোঁদাই করেছেন। তারাই বুঝিয়েছেন- নগ্নতা মানেই অশ্লীলতা নয়।

আমাদের উপমহাদেশে গুহা ভাষ্কর্য, বিভিন্ন মন্দিরে লীলার চিত্র কোনটাই অশ্লীল নয়, বরং অত্যন্ত শিল্পসম্মত কাজ। আমাদের সংস্কৃতির সাথে শৈল্পিক নগ্নতার প্রাচীন সম্পর্ক বিদ্যমান।

চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সেই অর্থে খুবই নতুন। একটার বয়স একশর কিছু বেশী। আর টেলিভিশন এখনো একশ বছর হয় নাই।

নাটকে সিনেমায় অভিনেতা অভিনেত্রীরা কাজ করেন পরিচালকের নির্দেশে। তাদের কাজ হলো চরিত্রটিকে যতটা সম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করে মানুষের সামনে তুলে ধরা। তাদের আলোচনা ও সমালোচনা হওয়া দরকার তাদের কাজের সুক্ষতার বিচারে।

এসব বলছি কী কারণে? কারণ হলো, অতি সম্প্রতি আমি বাংলাদেশে ধারণকৃত কয়েকটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে নানা রকম নেতিবাচক সমালোচনা দেখতে পেয়েছি। সারা দুনিয়াতে এরকম হাজার হাজার ওয়েব সিরিজ তৈরী হয়েছে, যেখানে নামকরা থেকে অনামী বহু অভিনেতা ও অভিনেত্রী কাজ করেছেন। এই মুহুর্তে হৈচৈ, আড্ডাটাইমস, জি ফাইভ, অ্যামাজন, নেটফ্লিক্সে এরকম কয়েক'শ ওয়েব সিরিজ আছে যেখানে স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্কের দৃশ্য আছে।

নগ্নতা দেখালেই তা অশ্লীলতা হবে কেন

বরং আমি কিছুদিন আগে কমলা রকেট নামক একটি ছবিতে নৌকায় করে এসে রকেট জাহাজে আটকে থাকা প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক করার সাজেস্টিভ দৃশ্য দেখেছি, যা অনেক অশ্লীল ছিল আমার বিবেচনায়।

প্রতিদিন কোন না কোন টেলিভিশনে বাংলা ছবির নারীর সম্ভ্রমহানির সাজেস্টিভ দৃশ্য ও বাসরঘরের প্রজাপতি, ফুলের ওপর মৌমাছি আর পায়ের সাথে পায়ের ঘষার ছবি দেখানো হয়, যা চুড়ান্ত অশ্লীল ও অসভ্য বলে মনে হয় আমার। সেগুলো নিয়ে কোন কথা বলে না আমাদের ভন্ড সমাজ। তারা পয়সা খরচ করে সেকরেড গেমস, নারকোস, লাস্ট স্টোরিজ দেখে সেটা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে। অনুরাগ কাশ্যপ নাকি মাধুর ভান্ডারকর, মহেশ ভাট, মুকেশ ভাট, এই নিয়ে বেশ তর্ক করে।

আমি আলোচনার কারণেই ওয়েব সিরিজটার বুমেরাং ও সদরঘাটের... দেখলাম। পরিচালকের নির্মানশৈলী ভালো। তারপর আরো দেখলাম ১৪ আগস্ট। মৌটুসী ও অর্ষা, শ্যামল মাওলা অত্যন্ত ভালো অভিনয় করেছে। আজাদ আবুল কালাম তার সুনাম বজায় রেখেছেন। হিল্লোল স্বাভাবিক ছিলো। মৌটুসী , শ্যামল ও অর্ষা প্রায় ঈর্ষা উর্দ্রেক করার মতো অভিনয় করেছে। অহনা ও তাসনুভা তিসাও খুব ভালো অভিনয় করেছে। ইমির অভিনয় একদমই ভালো ছিল না। ইমির মেকআপ থেকে শুরু করে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে অনুভূতির প্রকাশ কোনটাই মানসম্পন্ন ছিলো না। এটাকে বলে মিসকাস্ট।

আমি বরং বলবো অভিনয়ের কারণে এই ওয়েব সিরিজে চরিত্রগুলিকে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। আর এ কারণেই এই নিয়ে হাহুতাশ করাটা বরং অস্বাভাবিক। আমাদের উচিত এই ওয়েবের অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাহস, দৃৃষ্টিভংগী ও অভিনয়ে চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ততার প্রশংসা করা।

মীরজাফরকে বা নীলকরকে দর্শক জুতা নিক্ষেপ করলে, যদি সিরাজুদ্দৌলা বা নীলদর্পনের অভিনেতাদের আমরা ভালো বলি, তবে এই হাহুতাশ ও নেটে জুতানিক্ষেপ এর চেষ্টা প্রমাণ করছে যে অভিনয় অনেক ভালো হয়েছে। শিল্পীর কাজ চরিত্র চিত্রায়ন করা, সেন্সর করা না। একটা দুটো দৃশ্য না থাকলেও হয়তো কাহিনীর ক্ষতি হতো না। কিন্তু থাকাতে কোন সমস্যাও হয় নাই। 

শারীরিক মেলামেশার দৃশ্যগুলি নিয়েই সবার যতো আপত্তি। এরকম কি বাস্তবে হয় না? এরকম দৃশ্য কি নেটে আর কোথাও কোন ওয়েব সিরিজে নাই? যারা এসব বলছেন, তারা নিজের বাড়ীতে নেটফ্লিক্স হৈচৈ আমাজন থেকে কী দেখেন? এদের নামে কেন সাইবার আদালতে অভিযোগ পাঠান না? 

নাটকের অংশ কেটে কেটে জোড়া দিয়ে ক্লিপ তৈরী করাটাই বরং সাইবার অপরাধ। দৃশ্য দেখতে হয় পুরো ঘটনার আবহে। পদ্মানদীর মাঝির কপিলার স্নান বা সূর্যদীঘল বাড়ীর ডলি আনোয়ারের দশ সেকেন্ডের দৃশ্য কেটে পোস্ট করা হলো অশ্লীলতা। দৃশ্যটা অশ্লীল না। এই মানসিকতাই এক অসুস্থ মানসিকতা। টিভি নাটকে দুই রকমের অর্থবোধক সংলাপ ব্যবহার করা আরো বেশী অশ্লীলতা। এসব এত অশ্লীল যে আমি লিখতে পারলাম না। এসব যারা করেন তারা আরো অসুস্থ।

আপত্তির কারণ বলা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির কোথায় ছিল লিটনের ফ্ল্যাটে নায়িকাকে নিয়ে যাওয়ার সময়? কোথায় ছিল শত শত ছবিতে পায়ে পায়ে ঘষার দৃশ্যে এই সংস্কৃতি? কোথায় থাকে সংস্কৃতি যখন ধর্মীয় পন্থায় সালাম দিয়ে বেয়ান সাবের বুকের জমির দাম কত জিজ্ঞাসা করা হয়? ম্যাজিক মামনি, ডানা কাটা পরী প্রায় অর্ধ নগ্নতায় যখন নাচতে থাকে? এই ছবিগুলি তো সেন্সর হয়েছে, তাই না? এসবকে অশ্লীল মনে হয় না?

স্যাকরেড গেমস আর লাস্ট স্টোরিজ বানালে, অভিনয় করলে, দেখালে কারো কোন দোষ হয় না। কারণ এটা তো আমদানী হয়েছে। 

ভিন্ন দেশের সিরিজ বা সিনেমায় দেখলে কি তা অশ্লীলতা নয়? 

পরমাতে এই দৃশ্য ধারণ করে অপর্না সেন মহাপরিচালক হয়ে গেলেন। আমাদের চলচ্চিত্রবোদ্ধারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। দেশের বোদ্ধারা চলচ্চিত্র উৎসবে এটা দেখাতে থাকলেন, নারীরা নারী স্বাধীনতার স্বরুপ খুঁজলেন। তখন অশ্লীলতা হয় না?

আমাদের দেশের কেউ যদি হলিউডে গিয়ে এরকম দৃশ্যে অভিনয় করতেন তাহলে পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদ হয়ে যেতো। তখন কিন্তু কোন সমস্যা হতো না। শিল্পকে শিল্পের বিবেচনায় বিচার করে যুক্তি তর্ক হতে পারে। কিন্তু হায় হায় যায় যায় করে চিৎকার চেচামেচির কিছু নাই। এসব ভন্ডামী বাদ দিয়ে আসেন আমরা আমাদের অভিনেতা অভিনেত্রী, পরিচালক কলাকুশলীদের কাজের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করি।

সম্ভব হলে স্যাকরেড গেমস, লাস্ট স্টোরিজ নিয়ে কথা বলেন। এটার সমালোচনা করতে তো কাউকে দেখলাম না। পারলে অনুরাগ বা মহেশ ভাট এর নামে অভিযোগ করেন। (আমি নিজে এসব অভিযোগের পক্ষে নই। ভন্ডদের উদাহরন দেবার প্রয়োজনে বলেছি।)

ভন্ডামী বাদ দেন। শিল্পের মধ্যে শিল্প খোঁজেন। শিল্পকে শিল্পবোধ থেকে বিচার করেন, তথাকথিত জাজমেন্টাল দৃষ্টিভংগী থেকে বের হন। চোখ দিয়ে না দেখে, মন দিয়ে দেখেন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা