'আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে আমি বলতে চাই, তিনি যদি গঠনমূলক কোন কথা বলতে না পারেন, তবে যেন দয়া করে নিজের মুখটা বন্ধ রাখেন। তাতে ঝামেলা কমবে...'

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার দিকে আঙুল তুলে কিনা শাঁসাচ্ছেন তারই দেশের একটা অঙ্গরাজ্যের সামান্য একজন পুলিশ কমিশনার! পরামর্শ দিচ্ছেন চুপ থাকার! তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ হলে এতক্ষণে হয়তো ওই পুলিশ অফিসার জেলখানায় থাকতেন, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতো তার বিরুদ্ধে। মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর কোরিয়ায় হলে তো ফায়ারিং স্কোয়াডেই দাঁড় করিয়ে দেয়া হতো তাকে। আমেরিকা বলেই তিনি এখনও স্বপদে বহাল আছেন। শুধু তাই নয়, নেটিজেনরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধমক দেয়া অডিও ক্লিপটা অনলাইনে ফাঁস হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, সেটা শেয়ার দিয়ে সেই পুলিশ অফিসারের বাহাদুরির তারিফ করছেন সবাই। ভদ্রলোকের নাম আর্ট আসিভেদো। টেক্সাসের হিউস্টন শহরের পুলিশ সুপার তিনি। 

কয়েকদিন আগেই জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হয়েছেন পুলিশের বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে। তার প্রতিবাদে খুনের বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে লাখ লাখ মানুষ, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের #BlackLivesMatter আন্দোলনটা জীবন পেয়েছে আবার। চলছে বিক্ষোভ, আমেরিকার আশিটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন, সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে আছে শ্বেতাঙ্গদের অংশগ্রহণও। করোনার প্রকোপ, মৃত্যুর ভয়- সবকিছুকে পেছনে ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে মানুষ, আমেরিকার বুকে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। 

মিঃ হাইজিন জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

ন্যায়ের জন্য এত বড় একটা আন্দোলন হচ্ছে, অথচ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট শুরু থেকেই এই আন্দোলনের দিকে আঙুল তাক করে কথা বলছেন, হুমকি দিচ্ছেন, কখনও আন্দোলনকারীদের লুটেরা বলছেন, তো কখনও সেনা মোতায়েনের ধমক দিচ্ছেন। অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্ণরদের আদেশ দিয়েছেন কঠোর হাতে আন্দোলন দমন করার জন্যে। কিন্ত আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী, গভর্ণরেরা প্রেসিডেন্টের কথা মানতে বাধ্য নন। সবাই তো আর ট্রাম্পের মতো হুজুগে চলেন না, তারা চেষ্টা করছেন আন্দোলনকারীদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে, যথাযথ আশ্বাস দিয়ে তাদের ঘরে ফেরাতে। 

অথচ ট্রাম্প টুইটে একের পর এক তোপ দেগে যাচ্ছেন, আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা হোয়াইট হাউজের সামনে বিক্ষোভ করেছে, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ট্রাম্পের নিরাপত্তাকর্মীরা ভয়ে তাকে হোয়াইট হাউজের বাঙ্কারে নিয়ে গেছেন, সেখানেই নাকি রাত কেটেছে তার। ট্রাম্প সম্ভবত আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি হোয়াইট হাউজের বাঙ্কারে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন!

নিহত জর্জ ফ্লয়েড

তবে এতসবের পরেও ট্রাম্পের আস্ফালন থামেনি। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা না করে তিনি বকবক করে যাচ্ছেন এখনও। বিভিন্ন শহরের পুলিশ কমিশনারদের সঙ্গে এক টেলি-কনফারেন্সেও একই রকমের ভাষাপ্রয়োগ শুরু করেছিলেন তিনি। তখন তাকে থামিয়েছেন হিউস্টনের পুলিশ সুপার আর্ট আসিভেদো। গম্ভীর গলায় তিনি বলেছেন-

'আমেরিকার সবগুলো শহরের পুলিশ প্রধানদের পক্ষ থেকে আমি আমেরিকার সম্মানিত প্রেসিডেন্টকে বলতে চাই, তিনি যদি গঠনমূলক কোন কথা বলতে না পারেন, তবে যেন দয়া করে নিজের মুখটা বন্ধ রাখেন। তাতে ঝামেলা কমবে। এখন কঠোর হওয়ার সময় নয়, এখন সময় সবার মন জিতে নেয়ার, সবার বিশ্বাস অর্জন করার। তার পরিবর্তে উল্টোপাল্টা কথা বললে ভালো কোন ফল আসবে না।' 

ভাবুন তো, একটা শহরের পুলিশ চিফ তিনি, অথচ কি কঠোরভাবে প্রেসিডেন্টের ভুলের সমালোচনা করছেন, শিশুসুলভ আচরণের কারণে প্রেসিডেন্টকে ধমক দিচ্ছেন! বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ট্রাম্প, তার সামনে আসিভেদো পিঁপড়াও নন। অথচ সেই তিনিই ট্রাম্পকে তুলোধোনা করছেন এতগুলো পুলিশ অফিসারের সামনে! এটার নামই গণতন্ত্র, একেই বলে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। বিশ্বের অনেক দেশে এরকম কিছু করলে আসিভেদো এতক্ষণে জেলে থাকতেন, কিছু দেশে এমন কাজ করলে তো লাশটাও খুঁজে পাওয়া যেতো না! 

সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন আর্ট আসিভেদো

এই পুলিশ চীফ আর্ট আসিভেদোর জীবনটা কিন্ত সংগ্রামের এক জীবন্ত অধ্যায়। জন্মসূত্রে তিনি আমেরিকান নন, তার পরিবার আমেরিকায় পাড়ি।জমিয়েছিল কিউবা থেকে, তিনি তখন স্কুলে পড়েন। রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে প্রবাসে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, পরনের জামা ছাড়া সঙ্গে আনা যায়নি কিছুই। রিফিউজি ক্যাম্পে জীবন কেটেছে, বাবা-মা ইংরেজী জানতেন না, তাই ভালো কোন কাজও জোটেনি কপালে, দারিদ্র‍্যতাকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠেছেন, পড়ালেখা করেছেন নিজের পরিশ্রমে, মেধা আর যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আমেরিকান পুলিশ ফোর্সে চাকরি নিশ্চিত করেছেন। 

রিফিউজি হওয়ায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার অনুমতি ছিল না তাদের, টাকা জমাতেন প্লাস্টিকের পাইপের ভেতরে। সেই ইংরেজি না জানা, রাজমিস্ত্রীর ছেলে আসিভেদোকে আমেরিকার নাগরিক হবার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত। ক্লিনারের কাজ করে মাঝ বয়সে স্কুলে গেছেন তিনি, নিজের খরচ চালিয়েছেন, ডিগ্রী নিয়েছেন। সেই দেশ ছাড়া শরণার্থী কিশোরটা আজ টেক্সাসের একটা শহরের পুলিশ প্রধান, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চোখের দিকে তাকিয়ে যিনি কথা বলেন, যার ধমক খেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোকটা চুপ হয়ে যান! 

আর্ট আসিভেদোদের হাত ধরেই মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে, বর্ণবাদের অন্ধকার দূর হবে দুনিয়া থেকে- এই বিশ্বাসটা রাখা যায়। প্রেসিডেন্টের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যিনি মন আর বিশ্বাস জয়ের মিশনে নামেন, তার ওপর তো ভরসা করাই যায়! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা