![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/4/1/C34r4NlxwU95yWcPLKHxDZ6hYmwpJCmYR0VEDN5L.jpeg)
এপ্রিল ফুলের সঙ্গে রানী ইসাবেলা, স্পেনের লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে পুড়িয়ে মারার গল্পগাঁথা শুনেছেন নিশ্চয়ই! কিন্ত সেসবের কতটুকু সত্যি, কতখানি মিথ্যে, তা কি জানেন কেউ?
বয়স তখন অনেক কম। শিশুতোষ একটা পত্রিকায় প্রথম ‘এপ্রিল ফুল’ নামটা চোখে পড়ে। সেই এপ্রিল ফুলের সঙ্গে স্পেনের মুসলিমদের বঞ্চনার এক করুণ গল্প বা ইতিহাসকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে অদ্ভুত একটা রূপে পরিবেশন করা হয়েছিল লেখাটায়। ইন্টারনেট জিনিসটা সহজলভ্য ছিল না তখন, সত্যি-মিথ্যা যাচাই করারও কোন সুযোগ ছিল না। ছাপার অক্ষরে যা লেখা হয়েছে, সেটাকেই সত্যি বলে জেনে এসেছিলাম অনেকগুলো বছর ধরে।
এপ্রিল ফুল মূলত পাশ্চাত্য দেশগুলোতে পালন করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটায় পরিচিত লোকজন বা বন্ধুবান্ধবকে অদ্ভুত উপায়ে চমকে দিয়ে বোকা বানানোর এই রীতিটাকেই এপ্রিল ফুল নামে অভিহিত করে তারা। এই এপ্রিল ফুল নিয়ে আমাদের দেশের কাঠমোল্লাদের একটা বড় রকমের আপত্তি আছে। ভীনদেশী এই উৎসব বা রীতিনীতির পেছনে অদ্ভুত একটা ইতিহাস দাঁড় করেছে তারা, বড় করুণ সেই ইতিহাস। বাংলাদেশে এপ্রিল ফুলের নাম শুনেছেন, অথচ মনগড়া সেই গল্পগাঁথা শোনেননি, বা বিশ্বাস করেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। সেই কল্পকাহিনী বা বানানো ইতিহাসে চলে যাই।
স্পেনে তখন মুসলমানদের শাসনামল। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানেরা কর্দোভা জয় করে। সেভিলা হয়েছিল মুসলিম শাসকদের রাজধানী। শত শত বছর ধরে মুসলমানেরা স্পেন শাসন করেছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিম গবেষকদের জয়জয়কার তখন। কিন্ত মুসলমানদের এই আধিপত্য সহ্য হলো না ইউরোপের খ্রিষ্টান শাসকদের। অ্যারাগনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং পর্তুগীজ রানী ইসাবেলার নেতৃত্বে খ্রিষ্টান সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায় স্পেনে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তারা অগ্রসর হতে থাকে রাজধানী শহরের দিকে। গ্রানাডা অবরোধ করা হয়। খাবার বা অন্য কোনকিছুই শহরে ঢুকতে পারছিল নাম, পুরো গ্রানাডায় শুরু হয়েছিল দুর্ভিক্ষ। এই সময়ে খ্রিষ্টানদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, যদি মুসলমানেরা শহরের প্রধান ফটক থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয় এবং মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে, তাহলে বিনা রক্তপাতে সবাইকে মুক্তি দেয়া হবে। নইলে এই অবরুদ্ধ অবস্থাতেই খাদ্য-পানিবিহীন অবস্থায় জীবন দিতে হবে সবাইকে।
খ্রিষ্টান রাজার এই আহ্বান শুনে নাকি মুসলমানেরা অস্ত্র ফেলে দলে দলে আশ্রয় নিয়েছিল মসজিদে। কিন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে খ্রিষ্টান সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করে প্রতিটা মসজিদের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়, তারপর আগুন ধরিয়ে দেয় মসজিদে। প্রার্থনাস্থলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর-নারী। বিশিষ্ট মনগড়া ইতিহাসবিদেরা দাবী করে থাকেন, এই ঘটনা নাকি ১লা এপ্রিল ঘটেছিল, আর মুসলমানদের এই বোকামীর কারণেই নাকি পশ্চিমাবিশ্ব তাদেরকে কটাক্ষ করে এই দিনটায় লোকজনকে বোকা বানানোর এই রীতি পালন করে!
মোদ্দাকথায়, এই হচ্ছে বানানো ইতিহাসটা। এই গল্পগাঁথা শোনেনি, এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। শুধু যে অশিক্ষিত লোকজনই এই গল্পে বিশ্বাস করে তা’ই নয়, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরাও এই ঘটনাকে, বা এপ্রিল ফুলের সাথে স্পেনের মুসলমানদের যোগসূত্রের ব্যাপারটাকে সত্যি বলে মানে! প্রতিবছর পয়লা এপ্রিলে ফেসবুকে অনেককেই এই ‘হৃদয়বিদারক’ ঘটনাটা শেয়ার করতেও দেখা যায়। কিন্ত ইতিহাস কি বলছে? সেটা ক’জন জানার চেষ্টা করেছিলেন?
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/4/1/5Uq8cAoStbPUldoeKjldiz5pnKCSPpzg3aj10hwB.jpeg)
রানী ইসাবেলা প্রচণ্ড কৌশলী আর বুদ্ধিমতী একজন মহিলা ছিলেন। তিনিই কলম্বাসকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এক-দুইদিনে ঝটিকা আক্রমণ করে মুসলিম শাসকদের পরাজিত করা যাবে না। গ্রানাডাকে একটা দুর্গের মতো আগলে রেখেছিল মুসলিম সৈন্যেরা। ১৪৮২ সালে গ্রানাডা আক্রমণের লক্ষ্যে বেরিয়েছিলেন ইসাবেলা, মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন হয় ১৪৯২ সালে। প্রায় দশটা বছর ধৈর্য্য ধরে স্পেনকে দখল করতে মরিয়া হয়ে লেগে ছিলেন ইসাবেলা। ছোট ছোট অঞ্চলগুলো দখল করতে করতে গ্রানাডাকে অবরুদ্ধ করেছেন, তারপরে দখল করেছেন রাজধানী।
এই গল্পটার সবচেয়ে বড় খুঁত যেটা, সেটা হচ্ছে তারিখের বিভ্রাট। এখানে চারটি বইয়ের রেফারেন্স উল্লেখ করছি- অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত পেগী লিগসের লেখা ‘ইসাবেলা দ্য কুইন’, জন অ্যাডওয়ার্ডের লেখা ‘ফার্ডিন্যান্ড এন্ড ইসাবেলা’( পিয়ারসন এডুকেশন), আই এল প্লাঙ্কিটের ‘ইসাবেল অফ ক্যাস্টিল’ এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত জোসেফ ও’ কালাহানের বই ‘ এ হিস্টোরি অফ মিডিয়াভ্যাল স্পেন’ এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, ১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী গ্রানাডার মুসলিম শাসক দ্বাদশ মোহাম্মদ শান্তিপূর্ণভাবে পরাজয় মেনে নিয়ে রানী ইসাবেলা এবং রাজা ফার্ডিন্যান্ডের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। অর্থাৎ, এপ্রিল ফুলের তিন মাস আগেই গ্রানাডা নিজেদের দখলে নিয়েছিল খ্রিষ্টানেরা।
মসজিদের ভেতরে বন্দী করে ‘লক্ষ লক্ষ’ মুসলিমকে হত্যার বিষয়েও কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি ইতিহাসে, কোন ইতিহাসবিদ এরকম কোন ঘটনার কথা উল্লেখ করেননি কোথাও। তবে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় মসজিদটাকে খ্রিস্টানরা চার্চে রূপান্তরিত করেছিল, এমনটা বলেছেন কেউ কেউ। গ্রানাডা দখলের পরে স্থানীয় মুসলমান আর ইহুদীদের ওপর খ্রিস্টানেরা অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছিলেন, এমনটাও দাবী করেন অনেকেই। মুসলিম আর ইহুদীরা গ্রানাডা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেও মত দিয়েছেন কেউ কেউ।
মূলত এপ্রিল ফুলের সূত্রপাত হয় রোমান উৎসব হিলারিয়া থেকে। ইতিহসবিদদের মধ্যে বেশীরভাগই এই মতবাদেই সায় দিয়েছেন। মার্চের ২৫ তারিখে এই উৎসবটা পালন করা হতো। এছাড়াও প্রচলিত আছে যে, ফ্রান্স ১৫৬৪ সালে ফ্রান্স তাদের ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করে। মার্চের শেষ থেকে নতুন বছর শুরু হতো আগে, সেটা জানুয়ারী থেকে শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়। এটাই মানতে পারেননি অনেকে। তারা আগের সময়েই নববর্ষ পালনের পরিকল্পনা করলেন। কিন্ত যারা নতুন নিয়মের পক্ষপাতী তারা অন্যদলকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করলো, তাদের পিঠে পেপার ফিশ লাগিয়ে দিলো। সেই ঘটনাটা থেকেই এপ্রিল ফুলের উদ্ভব হয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। ১৬৯৮ সালের পয়লা এপ্রিলে বৃটেনে অনেক মানুষকে একসঙ্গে বোকা বানিয়ে টাওয়ার অব লণ্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখান থেকেও এটার উৎপত্তি হতে পারে বলে কারো কারো মতামত।
এপ্রিল ফুল নিয়ে এরকম বেশকিছু আলাদা আলাদা মতামত প্রচলিত আছে বিভিন্ন দেশেই। সে যাই হোক, যেখান থেকেই এপ্রিল ফুলের আইডিয়াটা আসুক না কেন, এর সাথে অন্তত মুসলিম হত্যা বা স্পেনের মুসলমানদের কোন লেনদেন নেই, এটা নিশ্চিত। কিন্ত তবুও একদল মানুষ গণ্ডমূর্খের মতো এসবে বিশ্বাস করে যাবে, ‘ঈমানী’ দায়িত্ব মনে করে এগুলো অন্যকে জানানোর মিশনে নেমে যায়। যারা এপ্রিল ফুলের সেই মনগড়া গাঁজাখুরি গল্পকথায় অবিশ্বাস করে, তাদেরকে নির্দ্বিধায় নাস্তিক-কাফের বলে গালাগাল দেয়! কিন্ত ইন্টারনেটের অগ্রগতির এই যুগে এসেও সত্যিমিথ্যা যাচাই করার আগ্রহটা সবার নেই, এটাই হতাশার!
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী, এনডিটিভি ডটকম, টাইম ডটকম, এ হিস্টোরি অফ মিডিয়াভ্যাল স্পেন।