এ পি জে আবদুল কালাম- দ্য মিসাইলম্যান অব ইন্ডিয়া!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সবাই পারে না, কেউ কেউ পারেন। মিসাইলম্যান খেতাব পাওয়া এ পি জে আবদুল কালাম তাদেরই একজন! নিজের মেধা আর পরিশ্রমে দরিদ্র এক জেলেপল্লীর কুঁড়েঘর থেকে যিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে।
পেই কারুম্বু, চেন্নাইয়ের রামেশ্বরমের ছোট্ট একটা গ্রাম। এখানকার মানুষজনের জীবন-জীবিকা সবটাই সাগর নির্ভর। মাছ ধরেই পেট চালায় সবাই। শান্ত, নিরিবিলি এই গ্রামটায় আজ লাখো মানুষের ভীড়। দেশ বিদেশ থেকে সবাই ছুটে এসেছে এই গ্রামেরই এক কৃতি সন্তানকে শেষ বিদায় জানাতে। প্রাক্তন ছাত্ররা সব কাজ ফেলে এসেছে ওদের প্রিয় শিক্ষককে শেষবারের মতো দেখবে বলে। পুলিশ আর অন্যান্য আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে গিজগিজ করছে রাস্তার মোড়গুলো। বাতাসে কেমন একটা বিষণ্ণতার গন্ধ পাচ্ছে সবাই, বেদনাবিধুর একটা গুমোট আবহাওয়া। আর্মি ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়েছে মৃতদেহ, লোকাল বাসস্ট্যান্ডের সামনে সবার জন্যে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে, যাতে প্রিয় মানুষটাকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে পারে সবাই।
এ পি জে আবদুল কালাম, ভারতের মিসাইলম্যান, চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন কফিনের ভেতর। পেই কারুম্বু গ্রামের দরিদ্র এক জেলের ছেলে, নিজের চেষ্টা, মেধা আর অধ্যবসায়ের জোরে যে হয়েছিল ভারতের এগারোতম রাষ্ট্রপতি, যার হাত ধরে সফলভাবে উড্ডয়ন করেছিল ভারতের স্বপ্নের মিসাইল- সেই আবদুল কালামকে বিদায় জানাতেই সেদিনের এত আয়োজন!
পম্বন দ্বীপের একেবারে হতদরিদ্র্য এক পরিবারে জন্মেছিলেন মানুষটা। বাবা নৌকায় করে মাছ ধরতেন সাগরে, আর গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর চেয়েও খারাপ ছিল অবস্থা, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় তার আবদারগুলো রাখার চেষ্টা করতেন বাবা মা। পড়ালেখার দিকে ছেলের ঝোঁক দেখে তাকে পাঠানো হলো সরকারী স্কুলে। পেটে ভাত নেই, তবে বিদ্যা অর্জনের বাসনা আছে মনে। কতবার পড়ালেখা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে, কিন্ত হাল ছাড়েননি আবদুল কালাম, পরিবারও পাশে ছিল তাঁর। নিজেরা অশিক্ষিত না হলেও শিক্ষার গুরুত্ব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা।
আহামরি ভালো ছাত্র ছিলেন না কালাম। তবে আগ্রহ ছিল ভীষণ, বিশেষ করে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। তিরুচিপাল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর সবাই ভেবেছিল এবার বুঝি ছেলে চাকুরীতে ঢুকে সংসারে থিতু হবে। কিন্ত কালামের খেয়াল ছিল অন্যকিছু। জ্ঞানার্জনের ভূত চেপে বসেছিল মাথায়, গবেষণাধর্মী কিছু করবেন ঠিক করলেন। চলে গেলেন মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে, মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে শুরু করলেন এখানে।
পড়ার খরচটা নাহয় স্কলারশীপে চালিয়ে দেয়া গেল, কিন্ত থাকা-খাওয়ার টাকা আসবে কোত্থেকে? এগিয়ে এলেন কালামের বড় বোন। নিজের বিয়ের গয়না ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই ভদ্রমহিলা! এমআইটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলেন ১৯৬০ সালে। এখানে থাকাকালে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। তার ডিপার্টমেন্টের ডীন একবার এক সিনিয়র ক্লাস প্রোজেক্টে তার কাজে বেশ অসন্তুষ্ট হলেন, হুমকী দিলেন, আগামী তিনদিনের মধ্যে প্রোজেক্টটা আবার ঠিকভাবে জমা দিতে না পারলে তার স্কলারশীপ বাতিল করে দেবেন।
ব্যাপারটা মোটামুটি অসম্ভবই ছিল, কিন্ত কঠোর পরিশ্রমী আবদুল কালাম তিনদিনের সময়সীমা পার হবার আগেই সেটা সম্পন্ন করে ডীনের রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডীন বলেছিলেন, "আমি জানতাম তুমি পারবে, এজন্যেই সময় কমিয়ে বলেছিলাম। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, চাপে তুমি ভেঙে পড়ো কিনা।"
কালামের স্বপ্ন ছিল পাইলট হবার, ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের বাছাই পরীক্ষায় সারাদেশের মধ্যে তিনি হয়েছিলেন নবম। কিন্ত প্রথম আটজনকেই শুধু সুযোগ দেয়া হয়েছিল, স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল কালামের। কিন্ত তিনি ভেঙে পড়েননি একটুও। এমআইটি থেকে পাশ করে অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট অর্গানাইজেশনে যোগ দেন। ছোট হোভারক্রাফটের ডিজাইন করাটাই ছিল তার কাজ। এই সময়ে তিনি কাজ করতেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের অধীনে।
১৯৬৯ সালে কালাম বদলী হলেন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে। ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট ভেহিকেল প্রোজেক্টের প্রধান করা হয় তাকে। ১৯৮০ সালে তার নেতৃত্বেই 'রোহিনী-১' স্যাটেলাইট নিক্ষেপ করেছিল ভারত। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার নাম, ভারতের মহাকাশ গবেষণাক্ষেত্রে তিনি তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি! ১৯৯২-৯৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন, এই সময়ে পোখরান-২ পারমাণবিক পরীক্ষার প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে মিসাইলম্যান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন আবদুল কালাম।
২০০২ সাল, বিজেপি তখন ক্ষমতায়। এ পি জে আবদুল কালাম নির্বাচিত হলেন ভারতের এগারোতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে! একবেলা ভাত খেলে যে পরিবারের সদস্যেরা চিন্তা করতো পরের বেলায় কি খাবে, কিভাবে ব্যবস্থা হবে, সেই পরিবারের সন্তান হয়ে আবদুল কালাম অলঙ্কৃত করলেন রাষ্ট্রপতির আসন! যাকে একটা সময়ে পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্যে বোনের গয়না বিক্রি করতে হয়েছিল, তিনিই সাফল্যের শিখরে চড়ে পরিণত হলেন ভারতের সর্বোচ্চ পদে। বিমানবাহিনীতে পরীক্ষা দিয়েও সুযোগ পাননি যে মানুষটা, তিনিই হয়ে গেলেন ভারতের তিনটি সামরিক বাহিনীর প্রধান!
রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম। এই পাঁচটা বছরেও কত রূপকথার গল্পের জন্ম হয়েছে তার হাত ধরে! ভারতের রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে আবদুল কালাম তৃতীয় ব্যক্তি, যিনি এই পদে আসীন হবার আগেই পেয়েছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্নের খেতাব। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথা অনুযায়ী সম্মেলন ভাতা নেয়ার বিরোধী ছিলেন তিনি। তার মতে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে যেকোন সভায় উপস্থিত থাকার কারণে সম্মানীভাতা নেয়াটা তার জন্যে বিব্রতকর ছিল।
তাকে বলা হয় পিপল'স প্রেসিডেন্ট, সম্ভবত ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতিও তিনিই। বিশটি প্রাণভিক্ষা আবেদনে সাড়া না দেয়ায় অবশ্য সমালোচনাও হয়েছিল তার। এদের মধ্যে ছিল ধনঞ্জয় চ্যাটার্জী এবং জঙ্গী আফজাল গুরুর ফাঁসি মওকুফের আবেদনও। অবশ্য তিনি বরাবরই নিজের যুক্তিতে অটল থেকেছেন, যেটা ভালো মনে হয়েছে, যে পথটাকে সত্য মনে হয়েছে, এ পি জে আবদুল কালাম হেঁটে গেছেন সেই পথ ধরেই।
২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ শেষ হলে সরে দাঁড়ান তিনি। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস তাকে রাখতেই চেয়েছিল এই পদে, কিন্ত তার নিজের কাছে মনে হয়েছিল, 'আবদুল কালাম' নামটাকে নিয়ে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোট দখলের চেষ্টা করছে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ, সেই সুযোগটা তিনি কাউকে দিতে চাননি। ধর্ম বলতে তিনি মানবধর্মকেই বুঝতেন। ২০১২ সালে প্রতিভা পাতিল যখন রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়লেন, তখনও অনেক গুজব ছড়িয়েছিল দ্বিতীয় মেয়াদে কালামের রাষ্টপতি হবার ব্যপারে।
কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে মূলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী দল এবং মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস তার নাম প্রস্তাব করেছিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্ত তিনি প্রচারের আলোর বাইরের ওই নিভৃত জীবনটাকেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন, সেটা ছেড়ে আর এই জনারণ্যে ফিরতে চাননি আবার। শিক্ষকতার পেশাটাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন, ভালোও বাসতেন। রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়ার পরে অতিথি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে, এই প্রতিষ্ঠানের শিলং, আহমেদাবাদ আর ইন্দোর শাখায় ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিতেন নিয়মিতই। সেইসঙ্গে তামিলনাড়ুর আন্না ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও সাহচর্য পেতো তার।
২০১৫ সালের সাতাশে জুলাই, শিলঙের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে 'বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার উপায়' শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়েছিলেন তিনি। প্লেনের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়েই বুকে ব্যথা অনুভব করেছিলেন, পাত্তা দেননি তেমন। বয়স হয়েছে, এখন তো এসব গা সওয়া হয়ে গেছে একদম- এমনটাই ভেবেছিলেন হয়তো। ভীষণ সময়ানুবর্তী ছিলেন, ঠিক সাড়ে ছয়টায় তার মঞ্চে ওঠার কথা, একটা মিনিটও দেরী হয়নি আবদুল কালামের। মাত্র পাঁচ মিনিট বক্তৃতা দেয়ার পরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, সেই জ্ঞান আর ফেরেনি। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সন্ধ্যা ৭:৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ পি জে আবদুল কালাম, শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, সেই স্বপ্নকে পূরণ করার সাহস যোগাতেন যে স্বপ্নবাজ মানুষটা।
শ্রম আর অধ্যবসায়ের এক অনন্য নমুনা এ পি জে আবদুল কালাম, জন্মেছিলেন ১৯৩১ সালের ১৫ই অক্টোবর। নিজের মেধা আর পরিশ্রমে দরিদ্র এক জেলেপল্লীর কুঁড়েঘর থেকে যিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে, নিজেকে পরিণত করেছিলেন ভারতের সবচেয়ে সম্মানীত ব্যক্তি হিসেবে। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে পছন্দ করতো, সবাই ভালোবাসতো তাকে। এমন ভালোবাসা ক'জনের কপালে জোটে? কর্ম আর ব্যবহারে মানুষের সেই ভালোবাসা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সবাই পারে না, কেউ কেউ পারেন। মিসাইলম্যান খেতাব পাওয়া এ পি জে আবদুল কালাম তাদেরই একজন!