
আজকালকার দিনের মতো হুট করে দেখা, হুট হাট প্রেম এরকম হয়নি তাদের। দুইজনই নিজেদের মনের কথা প্রকাশে খানিকটা লাজুক ছিলেন। কিন্তু যখন ভালবাসলেন, তখন একে অপরের খারাপ সময়েও কি দারুণভাবে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন...
আয়ুষ্মান খুরানার কয়েকটি সিনেমা একসাথে দেখেছি, একটানা। ভাল কন্টেন্টনির্ভর সিনেমায় অভিনয় করে ইদানিং তো প্রাদপ্রদীপের পুরো আলোই নিজের করে নিয়েছেন। তার সিনেমা কিংবা অভিনয় অবশ্য এই লেখার বিষয়বস্তু না। অভিনয়ের বাইরেও জীবন আছে, সেই জীবনেও হয়ত অভিনয় আছে। কিন্তু, এই জীবনের কিছু গল্প তো সিনেমার চেয়েও সিনেম্যাটিক হতে পারে, তাই না? আমার কাছে আয়ুষ্মানের প্রেমের গল্পটা তেমনই অদ্ভুত দারুণ লেগেছে, কিছু গল্প শুনলে শান্তি আসে, ভাললাগা কাজ করে। মনের অজান্তেই বলতে ইচ্ছে, একজীবনেও এমন প্রেম না মরুক, টিকে থাকুক জনম জনম।
মেয়েটার নাম তাহিরা কাশ্যপ। আয়ুষ্মান, তাহিরা দুইজনের পরিচয়ের শুরুটা কোচিং সেন্টারে। তখন তারা কলেজে পড়েন, আজ থেকে এক যুগ আগের ঘটনা। কোচিংয়ে ষাট জন ছাত্রছাত্রী। এতজনের মধ্যে আয়ুষ্মান, তাহিরা নিজেদের খুঁজে নেবেন, এটা কি কেউ ঠিক করে রেখেছিল? কে জানে। তা না হলে, ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা কেন প্রথম দেখায় আয়ুষ্মানকেই পছন্দ করবে?
তাহিরা সেই কোচিং ক্লাসে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয় এবং আকাঙ্খিত নারী। কারণ, তিনি গড়পরতা মেয়েদের তুলনায় লম্বা, দেখতে সুশ্রী, আবার এক ধরনের অহমিকাবোধও ছিল তার মধ্যে, যা তাকে আরো আবেদনময়ী করে তুলেছে। অনেকের দীর্ঘশ্বাসের কারণ ছিলেন তিনি। তাহিরার পেছনে ঘুরবার মতো ছেলেদের অভাব ছিল না, অনেকেই তাহিরাকে ভালবাসা নিবেদনও করেছে, পাত্তা পায়নি। ওইদিকে আয়ুষ্মান তো পাত্তা না পাবার ভয়ে সেই অর্থে তাহিরার কাছাকাছি কখনো ঘেঁষতেই চায়নি। অথচ, প্রথম দেখায় সেও তাহিরাকে পছন্দ করে ফেলেছিল। কিন্তু, সাহসে কুলায়নি তার। তাহিরাও কি আর নিজে আগ বাড়িয়ে এসে ভাললাগার কথা বলবেন! ফলে, অদ্ভুতভাবে একই ক্লাসে থাকার পরেও একবছর তাদের মধ্যে কোনো কথা হলো না।
তাদের দেখা হওয়াটা খুব কাকতালীয় ব্যাপার। তাহিরার মা একদিন বললেন, দাওয়াত আছে। তাহিরার বাবার জ্যোতিষী টাইপ এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত। তাহিরার এক বান্ধবী আবার নিজের পড়ালেখা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগত। তাহিরা তাই জ্যোতিষীর বাড়িতে দাওয়াত শুনে বান্ধবীকে জানায়। বান্ধবী খুব আগ্রহ নিয়ে রাজি হয়। তার শখ, সে তার পরীক্ষার গ্রেডস কেমন হবে, এই বিষয়ক প্রশ্ন জেনে নেবে৷ বান্ধবীকে সাথে নিয়ে তাহিরা সেই পারিবারিক দাওয়াতে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে সে দেখতে পায়, জ্যোতিষী আর কেউ নয়, আয়ুষ্মানের বাবা।
তারা দুইজন পারিবারিক সম্পর্কসূত্রে পাওয়া এই দাওয়াতে নিজেদের দেখে অবাক হয়ে যায়। সেদিন তারা কথা বলেন একে অপরের সাথে। তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়। আয়ুষ্মান গান গেয়ে শোনান পারিবারিক পার্টিতে। সেটা তাহিরার পছন্দও হয়। তবে কেউই কাউকে তখনো জানান দেননি, দুইজনই মনের অন্দরমহলে আগে থেকেই ভালবাসার স্বপ্ন বুনছেন।
আজকালকার দিনের মতো হুট করে দেখা, হুট হাট প্রেম এরকম হয়নি তাদের। দুইজনই নিজেদের মনের কথা প্রকাশে খানিকটা লাজুক ছিলেন। কিন্তু, এটাও সত্য দুইজনই শুরু থেকেই একে অপরকেও পছন্দও করতেন। তাহিরা যখন জানলেন, আয়ুষ্মান তাকে পছন্দ করত শুরু থেকেই, সে যেমন অবাক হয়, আয়ুষ্মানও বিস্মিত হয় তাহিরা তাকে পছন্দ করত এটা জেনে। আয়ুষ্মান বলেন, "আমি খুবই সাধারণ ছিলাম। ক্লাসে আমার চেয়ে আরও অনেকবেশি হ্যান্ডসাম ছেলে ছিল। তাদের বাইক ছিল। আমি ভাবতাম আমাকে দিয়ে সম্ভব নয়। আর প্রায় প্রতিটি ছেলেই তাহিরাকে পছন্দ করতো। অথচ পরে জানি তাহিরা আমাকে শুরু থেকে পছন্দ করত!"

দুইজনেরই প্রথম প্রেম, সম্ভবত শেষও। কারণ, এখনো কি দারুণভাবে একে অপরকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন। গেল বছর শেষের দিকে তাহিরার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে। চুল ফেলে দিতে হয় সম্পূর্ণ চিকিৎসার স্বার্থে। আয়ুষ্মান সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেন। তাহিরা যেরকমই থাকুক, যতই তার বাহ্যিক অবয়ব বদলে যাক, আয়ুষ্মানের কাছে তাহিরা চিরকালই তার ভালবাসা হয়েই থাকবে।
মজার ব্যাপার হলো, এই সম্পর্কে দুইজনই কোনো না কোনো সময়ে স্যাক্রিফাইস করে গেছেন। আট বছর আগে যখন তাহিরার সাথে আয়ুষ্মানের বিবাহ হয়, তখনও আয়ুষ্মান সফল কেউ নন। তাকে সেসময় খুব বেশি লোকেও চিনত না। তখনো কেউ জানত না, আয়ুষ্মান একদিন বলিউডে নিজের একটা শক্ত জায়গা করে নেবেন। তাহিরাও জানতেন না৷
তারা দুইজনই একসাথে পড়ালেখা শেষ করেন, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকের পর, মাস কমিউনিকেশন নিয়ে মাস্টার্স করেন৷ তাহিরার ক্যারিয়ার আয়ুষ্মানের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল ছিল আপাতদৃষ্টিতে। তাহিরা বেশি টাকা ইনকাম করত। সে মেধাবীও বটে প্রচন্ড। এরকম অবস্থায় কোনো নারী যদি তার 'স্ট্রাগলিং' প্রেমিককে ছেড়ে চলেও যায়, তাকে কি কিছু বলার থাকবে! তাহিরা ছেড়ে গেলেন না আয়ুষ্মানকে৷ তিনি তো আর 'সাফল্য'কে বিয়ে করবেন না, করবেন তার ভালবাসার মানুষ আয়ুষ্মানকে। সেটাই করেছেন।
প্রথমদিকে আয়ুষ্মানকে ফিনানশিয়ালিও সাপোর্ট দিতেন তাহিরা৷ আয়ুষ্মান তাই চিরকাল তার স্ত্রীর অবদানকে স্মরণ রাখবেন, একথা বলাই বাহুল্য। তাহিরাকে নিয়ে আয়ুষ্মান বলেন, "আমাদের যখন বিয়ে হয় আমার কাছে টাকা পয়সা কিছুই ছিল না। তবে পড়াশুনা শেষে তাহিরা বেশ ভালো চাকরি পেয়ে যায়। অনেক বেশি রোজগার তখন ওর। শুধু ভালোবাসার খাতিরে সে আমাকে বিয়ে করে। তাহিরা রকস্টার, কলেজে যেমন পড়াত তেমনি একটি পিআর ফার্মেও জব করত। আবার একটা রেডিও স্টেশনের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। আর আমি একজন স্ট্রাগলিং অ্যাক্টর, ভবিষ্যতে আদৌ কোনদিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব কি না জানতাম না। কিন্তু তাও সে আমার পাশে থেকেছে। তাহিরা কোনদিন একবারের জন্যেও বিরক্তি প্রকাশ করেনি। তাহিরা যেন সত্যিকার অর্থে আমাদের বাড়িরই মেয়ে হয়ে উঠেছিল। আমার বাবা মায়ের অনেক প্রয়োজনের কথা আমি নিজেও জানতাম না। তাহিরা ঠিকই জানত। বাবা-মায়ের দরকারটাও তাহিরাই মেটাত।"
বিয়ের একবছর পর আয়ুষ্মান বড় একটা সুযোগ পান বলিউডে। 'ভিকি ডোনার' সিনেমা দিয়ে আয়ুষ্মান বাজিমাত করেন। সেই সিনেমায় তার গাওয়া 'পানি ধা' গানটি দীর্ঘদিন টপচার্টেও ছিল৷ ভালবাসার বিয়ে কিন্তু দুইজনের ক্যারিয়ার চয়েজের কারণে দুইজনকে বিয়ের পর অনেকদিন 'লং ডিস্টেন্স রিলেশনশীপ' মেইনটেইন করতে হয়। আয়ুষ্মান চলে যান মুম্বাইতে। তাহিরা তখন থাকতেন চন্ডিগড়ে৷ কয়েকবছর এভাবেই চলে যায়। দুইজন মানুষ ভালবাসেন বলে কেউ কাউকে সম্পর্কের অজুহাতে বন্দী করে রাখতে চাননি। দুইজনই চেয়েছেন যেন দুইজনই ভাল ক্যারিয়ার গড়তে পারেন।
দুইজনই একজন আরেকজনকে এপ্রিশিয়েট করেন, কাজ নিয়ে পরামর্শ করেন, আলোচনা করেন। ভালবাসা মানেই তো পেছন থেকে লাগাম টেনে ধরা না, অতিরিক্ত পজেসিভ হওয়া না। এভাবেও ভালবাসা যায়। তাহিরা যেমন আয়ুষ্মানের দুখের দিনে চোখ বন্ধ করে পাশে ছিলেন, এখন তাহিরার ক্যান্সারের লড়াইয়ে তার পাশে সবচেয়ে বেশি করে আছেন আয়ুষ্মান। যখন শুনলেন তাহিরার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে, আয়ুষ্মান ভেবে পাচ্ছিলেন না কীভাবে কী করবেন। কিন্তু, তিনি দ্রুতই নিজেকে তৈরি করেছেন। স্ত্রীকে সাহস জুগিয়েছেন। তখন তার 'আন্ধাধুন' এবং 'বাধাই হো' সিনেমার প্রচারণার কাজের ধুম। দিনের বেলা তিনি কাজ করে হাসপাতালে ছুটতেন। সারারাত জেগে বসে থাকতেন স্ত্রীর কাছে। টানা সাতরাত এভাবে নির্ঘুম ছিলেন তিনি।
তাহিরাও কম যান না। অদম্য মনোবল তার। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সব চুল ফেলে দিতে হয়েছে তাকে। নিজের কেশহীন মাথার ছবি পোষ্ট দিয়ে তিনি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, এখন তার আরো বেশি স্বাধীন মনে হচ্ছে নিজেকে। কেশহীন এইরুপ অবস্থাকেও তিনি স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন, ক্যান্সারকে হারিয়ে দিতে লড়াই করছেন এই বার্তা দিলেন যেন। আর আয়ুষ্মানও এই ছবিতে মন্তব্য লিখেছে, তাহিরাকে 'হটি' মনে হচ্ছে তার। দুইজনের এই ক্যামিস্ট্রি কি যে মুগ্ধকর, আহা! ভালবাসার রসায়ন আর বেঁচে থাকার এই লড়াইয়ের শেষটা সুখের হোক, হবে নিশ্চয়ই!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন