
"আমি আমার সিনেমা দিয়ে কোন কিছু প্রমাণ বা কোন ম্যাসেজ দিতে চাই না। আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি, তা-ই তুলে ধরি। মানব ইতিহাসের প্রতি অধ্যায়েই অপরাধ ছিল, তাহলে সিনেমায় কেন নয়!"
নায়ক নায়িকার দেখা, অতঃপর তাদের আশপাশ থেকে মাটি ফুঁড়ে শ’খানেক সাইড ডান্সারের আগমন এবং শেষমেশ ‘আমি তোমার তুমি আমার’ টাইপ গানে উদ্দাম নৃত্য-ভারতীয় সিনেমা বলতে দর্শকরা একসময় এটাই বুঝতেন। তারপর তিনি এলেন, বদলে দিলেন বলিউডি সিনেমার সংজ্ঞা। মূলধারার সিনেমাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ফ্যান্টাসি বা ফিকশনের বাইরে নিজের মত করে বলিউডি সিনেমায় নতুন এক ধারার জন্ম দিলেন। পাঠক, আন্দাজ করুন তো কে?
বলছিলাম ‘দেব ডি’, ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, ‘নো স্মোকিং’ ও 'স্যাক্রেড গেমস' এর পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের কথা। মেধাবী এই সিনেমা পরিচালকের জন্ম হয়েছিল ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭২। বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, মা ছিলেন গৃহিণী। বেড়ে ওঠা বারানসিতে। স্কুলের পাঠ শেষে বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমান দিল্লিতে। সেখানে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে জুওলজিতে ভর্তি হন। ছাত্র হিসেবে বরাবরই ভাল ছিলেন অনুরাগ। জুওলজিতে ভর্তি পর্যন্ত ঠিকই চলছিল তার সবকিছু। কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তির পর ছোট্ট একটি ঘটনা তার পুরো জীবন বদলে দেয়।
“১৯ বছর বয়সে আমি যখন দিল্লিতে এলাম, বিজ্ঞানী হবার স্বপ্নে তখন বিভোর হয়েছিলাম। রেজাল্ট ভাল ছিল, পছন্দের বিষয়ে সহজেই ভর্তি হতে পেরেছিলাম। এরপরে একদিন, দিল্লি ফিল্ম ফেস্টিভালে একটা সিনেমা দেখি, সিনেমাটার নাম ছিল ‘দ্যা বাইসাইকেল থিফ’। সিনেমাখানা যখন শেষ হল, আমার মনে হল ‘দ্যাট ইজ হোয়াট আই ওয়ান্টেড’। আমাকে সিনেমা বানাতে হবে। তারপর সাতপাঁচ না ভেবে বোঁচকাবুচকি সহ রওয়ানা দিলাম মুম্বাইতে। আমার পকেটে সেদিন ছিল মোটে ৫০০০ টাকা”।
পকেটে ৫০০০ টাকা আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাইতে আসা অনুরাগ কাশ্যপের শুরুটা সহজ ছিল না। টাকা ফুরিয়ে যাবার পরে বাসায় যোগাযোগ করেন, কিন্তু লাভ হয়না কোন। পড়াশুনা ছেড়ে দেয়া সন্তানকে বাবা-মা নিজের রাস্তা নিজে দেখতে বলেন। সিনেমার কাহিনী, না পাঠক?
“মুম্বাইয়ের মত শহরে টাকাপয়সা ছাড়া টেকা মুখের কথা না। আমার পকেটে ওই সময়ে ফুটোটিও ছিল না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম, থাকতাম সেইন্ট জেভিয়ার কলেজের পানির ট্যাঙ্কির নিচে। আমি ওই সময়ে জীবন ও মাদকের সম্পর্ক সম্বন্ধে জেনেছি। বলতে পারেন ওই পানির ট্যাঁঙ্কিখানা আমার উপরে বড় রকম প্রভাবই রেখেছে”।
রাস্তায় ঘুরতে ফিরতে থাকা অনুরাগ একসময় ‘পৃথিবী’ নামের এক স্ট্রীট থিয়েটারে যোগ দেন। এই থিয়েটারে কাজের সুবাদে পরিচয় হয় হানসাল মেহতার সাথে এবং তার সিনেমা ‘জয়তী’র স্ক্রিপ্ট লিখে দেন। সিনেমাটি রিলিজ না হলেও অনুরাগের ভিন্নরকম স্ক্রিপ্ট পছন্দ করেন থিয়েটারের সবাই। এরই সুবাদে ১৯৯৭ তে জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘কাভি কাভি’র স্ক্রিপ্ট লেখার সুযোগ পান তিনি। এরপরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। রাম গোপাল ভারমা এর ‘সত্য’, ‘কৌন’, ‘শূল’ এবং মনি রত্নমের ‘যুবা’ প্রভৃতি সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ করেন তিনি। বিশেষ করে ‘সত্য’ সিনেমার ডায়ালগ তো আজো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
স্ক্রিপ্ট তো অনেক লিখলেন অনুরাগ। কিন্তু আসল কাজটাই তো বাকি রয়ে গেছে তার। নিজে একটা সিনেমা বানাতে হবে। ২০০৪ সালে অবশেষে শুরু করলেন নিজের সিনেমার কাজ। সিনেমার নাম ব্ল্যাক ফ্রাইডে। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র কাহিনী আবর্তিত হয়েছে নব্বই এর দশকের বোম্বে বোম্বিং নিয়ে। প্রথম সিনেমাতেই বিতর্কিত একটি বিষয় টেনে এনে দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন অনুরাগ। সিনেমাখানা রিলিজ নিয়েও সেসময় কম নাটক হয়নি। সেন্সরবোর্ড ছেড়ে দিলেও মহামান্য হাইকোর্ট থেকে বলা হয় ৯৩’র সেই বোম্ব ব্ল্যাস্টের কেইসের রায় না হওয়া পর্যন্ত এই সিনেমা রিলিজের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি বহাল থাকবে।
রিলিজের পরে অবশ্য সমালোচকরা এ সিনেমার ভূয়সী প্রশংসা করেন। স্লামডগ মিলিয়নেয়ার এর পরিচালক ড্যানি বয়েল একবার সাক্ষাতকারে বলেন, স্লামডগ মিলিয়নেয়ার এ বস্তির ভেতরে নায়কের পুলিশী ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার একটি দৃশ্য আছে। এটি আমি অনুরাগ কাশ্যপের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ সিনেমাতে পুলিশী ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ১২ মিনিটের একটি দৃশ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করেছি।
এরপরে হলে আসে অনুরাগের ‘নো স্মোকিং’। সিনেমাতে দেখা যায় চেইনস্মোকার জন আব্রাহামের সিগারেট ছাড়ানোর অভিনব এক কাহিনী। সমালোচকরা প্রশংসা করলেও বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে সিনেমাটি। সেসময়ে দর্শকেরা সিনেমাতে খোলামেলা মাদকদ্রব্য নেয়ার দৃশ্যেরও কড়া সমালোচনা করেন, যা অনুরাগ কাশ্যপের দুই ছবি বয়েসি ক্যারিয়ারকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেয়।
এরপরই আসে তার সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত মুভি ‘দেব ডি’। অনুরাগ এই সিনেমাতে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ বিংশ শতাব্দীতে জন্মালে কেমন হত তা দেখিয়েছেন। এই সিনেমাতে দেবদাসের ভূমিকায় ছিলেন অভয় দেওল, পার্বতীর ভূমিকায় ছিলেন মাহী গিল এবং চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় ছিলেন কাল্কি কোয়েচলিন। সিনেমাখানা বক্সঅফিসে দারুণ সাড়া ফেলে। সমালোচকেরাও পরিচালক অনুরাগের প্রশংসায় মেতে উঠেন। এক সমালোচক বলেন, ‘এটা হল ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে দেবদাসকে নিয়ে তৈরি চতুর্দশতম এবং আমার দেখা সেরা ‘দেবদাস’। এত এত দেবদাসের ভিড়ে এই ‘দেবদাস’কে ভারতীয় দর্শক বহুদিন মনে রাখবে’।
সিনেমায় দেখানো অন্তরঙ্গ দৃশ্য এবং এমএমএস স্ক্যান্ডাল বেশ বিতর্কের জন্ম দিলেও অনুরাগের ‘ক্রাইম সাসপেন্স’ ধারাকে ভালভাবেই নেন দর্শকেরা। এরপরে ‘গুলাল’, ‘বোম্বে ভেলভেট’, ‘আগ্লি’ প্রভৃতি সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে তার স্থান পাকাপোক্ত করেন অনুরাগ। তার ক্যারিয়ারের এখন পর্যন্ত সেরা কাজের কথা বলতে গেলে বলতে হয় ২০১২ সালে রিলিজ পাওয়া ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ এর কথা।
সিনেমাখানা যখন অনুরাগ কাশ্যপ তৈরি করেছিলেন, তখন এর সময়কাল ছিল ৩১৯ মিনিট! কিন্তু সিনেমাহলগুলি সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার কোন সিনেমা দেখাতে নারাজ। শেষমেশ বাধ্য হয়ে পার্ট ওয়ান আর পার্ট টু তে রিলিজ করার সিদ্ধান্ত নেন পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, খুন, যৌনতা- এই হল ওয়াসিপুরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গল্প।
এই সিনেমাতে গা শিউরে উঠা এমন কিছু মৃত্যুদৃশ্য দেখানো হয়েছে যা হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে এর আগে কখনোই দেখা যায়নি! এই ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’এ অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপেয়ী, নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, হুমা কোরেশী সহ প্রমুখ শক্তিশালি অভিনেতা অভিনেত্রীর। ভারতীয় মাফিয়া পরিবারের সত্য গল্প অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমাখানা দর্শককে তাক লাগিয়ে দেয়। বিশেষ করে হুমা কোরেশী ও নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর অসম জুটি সেসময়ে ভারতে ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। চারখানা ফিল্মফেয়ার সহ সিনেমাটি টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভাল এবং পারী ফিল্ম ফেস্টিভালে বেশ কয়েকটি পুরস্কার জিতে নেয়।
অনুরাগ কাশ্যপের সব সিনেমাতেই মাদক, খুন, যৌনতা, অপরাধজগতের নানান জানা অজানা বিষয় উঠে এসেছে। তার সিনেমার আরেক বিশেষত্ব হল সিনেমার মিউজিক। ট্র্যাডিশনাল ফোক এবং মডার্ন মিউজিকের ফিউশন থাকে প্রায় সবগানেই। ‘আই অ্যাম এ হান্টার, শী ওয়ান্ট টু সি মাই গান’ ভুলেভরা বিদঘুটে ইংলিশ লিরিক, সাথে ফোক মিউজিক। আপনি চোখ বন্ধ করে শুধু শুনেই বলে দিতে পারবেন, ইহা কার তৈরি সিনেমা।
প্রথম স্ত্রী আরতি বাজাজের সাথে ডিভোর্সের পরে ‘দেব ডি’র নায়িকা কাল্কির প্রেমে পড়েন অনুরাগ। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে কাল্কির সাথেও সংসার টেকেনি অনুরাগের। দুই ভাইবোন অভিনভ এবং অনুভূতি ভাই অনুরাগের বেশকিছু সিনেমাতে প্রযোজক এবং সহ-পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। মূলধারার থেকে একেবারে ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে হাঁটা এই পরিচালকের আজ ৪৮ তম জন্মবার্ষিকী।
ভারতীয় সিনেমাতে এখন ক্রাইম সাসপেন্স ধারার সিনেমাবানিয়ে কম নেই, কিন্তু শুরুটা এই অনুরাগের হাত ধরেই। ‘দেব ডি’ রিলিজের পর তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, খোদ দেবদাসের গল্পেও কিভাবে তিনি অপরাধজগতকে টেনে আনেন? উনি হেসে বলেন, ‘আমি আমার সিনেমা দিয়ে কোন কিছু প্রমাণ বা কোন ম্যাসেজ দিতে চাই না। আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি, তা-ই তুলে ধরে। মানব ইতিহাসের প্রতি অধ্যায়েই অপরাধ ছিল, তাহলে সিনেমায় কেন নয়’!
‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, ‘দেব ডি’, গ্যাংস ওয়াসিপুর’- এরপরে কী বের হবে অনুরাগের জাদুর ঝুলি থেকে? অপেক্ষায় থাকি আমরা সেই পর্যন্ত । উইশিং এ ভেরি হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, অনুরাগ কাশ্যপ!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন