
২৭ বছরে উদ্ধার করেছেন ১৮ হাজার নারীকে। ৭০০ যৌন পাচারকারীকে আইনের আওতায় এনেছেন। সত্তর বছর বয়সে এসে যেখানে ক্লান্তির ভারে শরীর নুয়ে যায় এমনিতেই। নেপালের মাদার তেরেসা অনুরাধা কৈরালা যেন নিজেই পরিণত হয়েছে নারী জাগরণের মেরুদন্ডে।
মাদার তেরেসা, নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে মানবতা। বিশ্বজুড়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য এক অভয়রান্য, আশ্রয়স্থল। তিনি হয়তো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন ঠিকই, কিন্তু এ পৃথিবী এখনো তার মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। তাইতো আমরা এখনো যেখানে খুঁজি মানবতা, সেখানেই দেখি তেরেসার মুখ। মায়ের এমন প্রতিরূপ জগতজুড়ে এভাবে আর সমাদৃত হয়নি।
তেরেসার সেই নব্বই দশকেরই কথা। প্রতি সকালে পাশুপাতি দেখিনাথ মন্দিরে যেতেন নেপালের এক সাধারণ অধিবাসী অনুরাধা কৈরালা। সেই রাস্তায় তার সাথে দেখা হতো এক ভিখারির। এক দুই কথা আলাপ জমে গেলো সেই ভিখারি নারীর সাথে। জানলেন সেই নারী লিঙ্গ এবং পারিবারিক হিংস্রতার শিকার। এটা শুনে অনুরাধার মনে পড়ে গেলো নিজের কথা। প্রাক্তন স্বামীর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো অনুরাধার জীবন।
সেই জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছেন তেরেসার দীক্ষা গ্রহণ করেই। ২০ বছরের শিক্ষকতা জীবনেও রয়েছে মানবসেবার অগণিত অভিজ্ঞতা। তাতেও যেন মন ভরছিলো না অনুরাধার। মাত্র ৮ জন নারী নিয়ে ১৯৯৩ সালে শুরু করেন নারী জাগরণের মিশন। তৈরি করেন ‘মাইতি নেপাল’ নামের নন-প্রফিটেবল অর্গানাইজেশন। এরপরেই তার নজরে আসে নেপালে নারীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা, ‘যৌন পাচার।’
দেশটির অশিক্ষা এবং দারিদ্রের কারণে যৌন পাচারকারীদের উপদ্রব লক্ষ্য করা যায়। নেপাল থেকে নারীদের পাচার করা হয় ভারতে, সেখানে ব্যবহার করা হয় যৌন দাসী হিসেবে। অনুরাধা কৈরালা এই যৌন পাচার বন্ধের জন্য অনুরাধা কৈরালা কাজ করে যাচ্ছেন ২৭ বছর ধরে। নেপালের সাথে ভারতের সীমান্ত প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত। এসব সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়েই নারী পাচার করা হয়। ২০১৩ সালের পর থেকে এই পাচার বহুগুনে বেড়ে গিয়েছে। ২০১৬ সালেই পাচার করা হয়েছে কমপক্ষে ২৩ হাজার নারীকে। বর্তমানে যে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজারে।

অনুরাধা কৈরালের নেতৃত্বে মাইতি নেপাল কাজ করছে নেপাল-ভারতের সীমান্তবর্তী ২৬টি ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে। পাচারকারীদের কাছ থেকে মুক্ত করা নারীদের জন্য চালানো হচ্ছে ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র। শিশুদের জন্য খুলেছেন দুটি হাসপাতাল। সেই সাথে নেপালজুড়ে চলছে জনপ্রচারণা। ভিক্টিমদের সাথে নিয়ে খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে পাচারকারীদের। সম্প্রতি, নারী পাচারে ভুক্তভোগীদের কর্মসংস্থানের জন্য কাঠমুন্ডুতে খোলা হয়েছে একটি ক্যাফে। এসব কিছুর ব্যবস্থাই করেছেন অনুরাধা কৈরালা তার ‘মাইতি নেপাল’ এর মাধ্যমে।
এই দীর্ঘ পথচলায় নারী পাচার থেকে উদ্ধার করেছেন ১৮ হাজার নারীকে, তন্মোধ্যে এক হাজার শিশুও রয়েছে। ৭০০ যৌন পাচারকারীকে আইনের আওতায় এনেছেন। অনুরাধা কৈরালা তার এই অবদানের জন্য জয় করেছেন দেশবিদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক পুরস্কার। ভারতের পদ্মশ্রীসহ, সিএনএন হিরো অফ দ্যা ইয়ার ২০১০। সত্তর বছর বয়সে এসে যেখানে ক্লান্তির ভারে শরীর নুয়ে যায় এমনিতেই। নেপালের মাদার তেরেসা অনুরাধা কৈরালা যেন নিজেই পরিণত হয়েছে নারী জাগরণের মেরুদন্ডে।
একজন অনুরাধা যদি হয়ে উঠতে পারে তার দেশের মাদার তেরেসা। সেই অনুপ্রেরণা থেকে আমাদের দেশে রোকেয়াদের জাগরণ আশা করা যেতেই পারে। সেই জীবনবোধ থেকে যদি জন্ম নেয় এ যুগের মাদার তেরেসা কিংবা বেগম রোকেয়ারা। তবে সেই কৃতিত্ব অল্প কিছুটা হলেও অনুরাধা কৈরালার প্রাপ্য। ১৮ হাজার জীবন বাঁচানো তো আর চাট্টিখানা কথা নয়। প্রিয় অনুরাধা কৈরালা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নেবেন। এগিয়ে চলুক আপনার পথচলা।