অ্যান্টি-মাস্ক মুভমেন্ট: একদল কোভিড ইডিয়টের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মাস্ক পরার বিরুদ্ধেও যে ঘোরতর আন্দোলন হতে পারে, তা জানা ছিলো না অনেকেরই। দেশে দেশে এই কোভিড ইডিয়টরা ছড়িয়ে আছে, তাদের কর্মকাণ্ডও যথেষ্ট হাস্যকর, আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এদের সংখ্যা কিন্ত কম নয়, লাখ লাখ মানুষ নাম লিখিয়েছে এই মিছিলে...
করোনা যখন অল্প অল্প করে এ দেশে ঘাঁটি গাড়া শুরু করেছে, তখন একদল মানুষ খুব সাবধানী হয়ে গেলেন। পরিচিত মানুষজন দেখলেই তিন হাত দূর থেকে সতর্ক কুশলাদি বিনিময়, হাতে-পায়ে নিয়মিত বিরতিতে স্যানিটাইজার ঘষাঘষি, মুখে দুই-তিন স্তর বিশিষ্ট মাস্ক, হাতে গ্লাভস, চোখে-মাথায় প্রটেকশন... সে এক অবস্থা। লকডাউনের মধ্যে একবার মুদি দোকানে গিয়েছি আলু কিনতে। গিয়ে দেখি মুদি দোকানের পাশের অতিগোপনে খোলা চায়ের দোকানে সাদা ধবধবে পিপিই পড়া এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে খুব আরামে সিগারেট টানছেন। মনে হচ্ছিলো নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং চন্দ্রবিজয়'কে সেলিব্রেট করার জন্যে ধূম্রজাল বিস্তার করেছেন তার আশেপাশে৷ সে এক দৃশ্য! এখনো চোখে লেগে আছে।
তবে সমস্যা এই সাবধানী মানুষদের নিয়ে না। মহামারীর সময়ে একটু-আধটু সাবধানী হলে তা দোষেরও কিছু না৷ কিন্তু আসল সমস্যা হলো, যখন দেখা গেলো- এক শ্রেণির মানুষ দাঁড়িয়ে গেলেন- যারা করোনাভাইরাসকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। এবং শুধু যে নিজেরাই সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না, তা না, বরং যারা করোনাভাইরাসকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন, তাদের একহাত দেখে নিচ্ছেন তারা। ফ্রিস্টাইলে রাস্তায় ঘুরছেন৷ মাস্কের বালাই নেই। যা মনে চায় করছেন৷ নিজেরা মাস্ক পড়ুক আর না পড়ুক, অন্য কাউকে মাস্ক পড়া দেখলেও 'হ্যাহ্যা' করে দেঁতোহাসি দিচ্ছেন৷ বিদ্রুপ করছেন।
ভাবলাম, এটা সম্ভবত জাতীয় সমস্যা। বাঙ্গালীকে যে বিষয়ে নিষেধ করা হয়, বাঙ্গালী সেই জিনিসটি বেশি করে। এটাই নিয়ম৷ ইচ্ছে করেই হয়তো মাস্কটাস্ক ফেলে রেখে রাস্তায় নেমেছে তারা। এটাই ভাবলাম। কিন্তু আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেলো, যখন জানলাম- মাস্ককে বর্জন করার জন্যে বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলনও আছে, যেটির নাম Anti-Mask Movement. বেশ কয়েক মাস ধরে আমেরিকা আর ইউরোপে এই মুভমেন্ট চলছে। বেশ জ্বালাময়ী সংলাপ আর শ্লোগানও দেয়া হয় এই মুভমেন্টের বিভিন্ন কর্মসূচিতে। এই মুভমেন্টের সমর্থকদের কথা একটাই- মাস্ক পড়বেনা তারা৷ তাদের শরীর তাদের, সুতরাং তারা যা ইচ্ছে তাই পড়বে। অন্যের কথামত তারা কেন মাস্ক পড়তে যাবে! ইয়ার্কি হচ্ছে? তাছাড়া তাদের কাছে 'করোনাভাইরাস' একটি সামান্য রোগ। মিডিয়াই এই সামান্য সর্দিজ্বরের রোগকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এত বড় করেছে। এটার জন্যে এত সাবধানতা অবলম্বনের কিছু নাই।
করোনাভাইরাস কে নিয়ে বেশ কিছু 'কন্সপিরেসি থিওরি'ও আছে, তাদের কারো কারো মধ্যে। যে 'কন্সপিরেসি থিওরি' আমি আমার বন্ধুস্থানীয় কয়েকজনের কাছ থেকেও শুনেছি। তাদের বিশ্বাস, শুধু বিশ্বাসই বা বলছি কেন, তাদের দৃঢ়বিশ্বাস- করোনাভাইরাস আসলে সরকারের একটা গুজব৷ মানুষজনকে ঘরে আটকে রেখে সরকার গোপনে গোপনে বড় কিছু করতে যাচ্ছে৷ সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে করোনাভাইরাসের কথা বলে।
এদেরকে ডাকা হচ্ছে 'COVID-idiot' নামে। তাতে অবশ্য তাদের কোনো হেলদোল নেই। এরকম বৃহৎ আন্দোলনে দুয়েকটা উল্টাপাল্টা কথা আসবেই, এগুলো ধর্তব্যে নিলে তো চলবেনা৷ তাই তারা সেগুলো গননাতেও নিচ্ছেন না৷ তবে সচেতন মানুষেরা হাল না ছেড়ে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন, এই অপোগণ্ডদের শোধরানোর জন্যে। কিন্তু কোনোকিছুতেই কিছু হচ্ছে না তাদের৷ পোপ ফ্রান্সিস পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে বলেছে, ঘরে ফেরার জন্যে। কিন্তু তারা অনড়। ঘরেও ফিরবেনা, মাস্কও পড়বেনা। এবিষয়ে তারা কোনো ভিন্নমত শুনতে নারাজ।
অনেকেই জানেন, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি করোনাভাইরাস ঠেকাতে বেশ ভালোই সফল ছিলো। তুলনামূলকভাবে খুব বেশি মৃত্যুও হয়নি এই দেশে। সেই জার্মানিতেই মানুষজন লকডাউনের মাঝামাঝি সময়ে, আগস্টের ১ তারিখে লকডাউন ভেঙ্গে জার্মানির রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছিলো; লকডাউন তুলে নেয়ার দাবী জানিয়ে। ছোটখাটো বিক্ষোভ না। প্রায় সতেরো-আঠারো হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন সেই বিক্ষোভ সমাবেশে। মাস্ক না পড়ে, সামাজিক দূরত্ব না মেনে তারা করেছিলো আন্দোলন। তাদের মধ্যে কারো কারো এমনটাও বিশ্বাস ছিলো-করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন দিলে মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে যাবে (এই ভ্যাক্সিন-বিরোধীদের আরেকটা নামে ডাকা হয়- Anti Vaccination Organization; Anti Vaxxers)। তাই ভ্যাক্সিন দেয়া যাবে না। কারো কারো বিশ্বাস ছিলো, জার্মান সরকার মারাত্মক কিছু করতে যাচ্ছে, তাই তাদের আটকে রাখতে চাচ্ছে ঘরে। তারা উৎসাহী হয়ে পহেলা আগস্টকে 'End of Pandemic: Freedom Day' হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছিলো!
শুধু জার্মানির এই মানুষদের কথাই বা বলছি কেন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট কী কম? ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ভেবেছিলেন, করোনার সংবাদে মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, তাই টিভি-চ্যানেলে করোনার খবর সম্প্রচারই বন্ধ করে দিয়েছিলেন৷ আমেরিকার সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও মাস্ক পড়তেন না। মাঝেমধ্যেই করোনাভাইরাস নিয়ে বেফাঁস কথাবার্তা বলে ফেলতেন। ভারতের এক মন্ত্রী সবাইকে এক বিশেষ রকমের পাপড় খেতে বলেছিলেন, যা খেলে নাকি করোনা সেরে যাবে। ব্রিটেনের আরেক মন্ত্রী লকডাউনের মধ্যে স্ব-পরিবারে দেশভ্রমণ করে সবার বেশ সমালোচনা কুড়িয়েছিলেন। আমাদের দেশেও কী এরকম COVIDidiot নেই? কে বলেছে নেই? অজস্র উদাহরণ আছে। তবে তাদের মধ্যেও একজন মোটামুটি কিংবদন্তির পর্যায়েই চলে গেছেন। যিনি 'করোনাভাইরাস মুসলমানদের আক্রমন করবেনা' উক্তির প্রবক্তা এবং করোনাভাইরাস সমাধানের বিখ্যাত '1.Q7+6=13' সূত্রেরও জনক। তার নাম কী শুনতে চান? উত্তর হচ্ছে- এটা আমি জানি কিন্তু বলবো না।
মহামারী করোনা পৃথিবী থেকে এখনো নির্মুল হয়ে যায়নি। শীতের প্রকোপ বাড়ায় কিছু দেশে আবার করোনার ভয়ঙ্কর প্রলয় শুরু হতে পারে বলেও আশঙ্কা অনেকের। তবে মারাত্মক করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও এই COVIDidiot রা যেন একেকখণ্ড নির্মল বিনোদনের উৎস। সিরিয়াস সিনেমায় দুয়েকটা 'কমিক রিলিফ' ক্যারেক্টার যেমন থাকে, এরাও তেমনি। এদের কর্মকাণ্ড, পাগলামি, অবুঝ আচরণ, যাপিত শত সমস্যার মধ্যেও যে আমাদের মুখে একটু হলেও হাসি ফোটাচ্ছে, এও বা কম কী!
বেঁচে থাকুক এরা। হাসি, আনন্দে, বিনোদনের রসেবশে! এদের ভালো হোক।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন