আজ থেকে ১১৯ বছর আগে কাঠের পিঁপেতে চড়ে একজন মানুষ ঝাঁপ দিয়েছিলেন নায়াগ্রা ফলসের ওপর থেকে। বিজয়ীর বেশে মৃত্যুকে জয় করে ফিরেছিলেন তিনি। শুনলে অবাক হবেন, তিনি ছিলেন একজন নারী!

যারা নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা ধরণের আপাত অসম্ভব স্টান্ট দেখায়, তাদেরকে বলা হয় 'ডেয়ারডেভিল'। আজকের দিনে এরকম ডেয়ারডেভিল হরহামেশাই দেখা যায়। গত শতাব্দীর শুরুতেও যে দেখা যেত না তা না। কিন্তু তাই বলে সামান্য একটি কাঠের পিপেতে করে নায়াগ্রা ফলস থেকে লাফিয়ে পড়া! এ তো ছিল স্রেফ কল্পনাতীত ব্যাপার। আর ঠিক এই কাজটিই করে গোটা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিলেন এক অসীম সাহসী নারী - অ্যানি এডসন টেইলর। তাও আবার ৬৩ বছর বয়সে!

১৯০১ সালের ২৪ অক্টোবর, নিজের ৬১তম জন্মদিনে এক অদ্ভুত ইচ্ছা পূরণের ভূত চেপে বসে অ্যানির মাথায়। কানাডায় অবস্থিত জগদ্বিখ্যাত নায়াগ্রা ফলসের ওপর অশ্বক্ষুরাকৃতি যে জায়গাটি আছে, সেখান থেকে একটি পিপেতে করে লাফিয়ে পড়বেন। এবং ঠিক ঠিকই সেই কাজটি করে ছেড়েছিলেন তিনি। এ কাজ যে তিনি একা একাই করেছিলেন, তা অবশ্য নয়। সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে ছিল তার ছোট্ট পোষা বিড়ালছানাটি। এর আগে নায়াগ্রা ফলসের এত উঁচু থেকে কেউ কখনো লাফিয়ে পড়ার কথা চিন্তাও করেনি। তাই সফল হওয়ার সাথে সাথেই অ্যানির কপালে জুটে যায় অবিস্মরণীয় এক বিশ্বরেকর্ড - ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানুষ যিনি নায়াগ্রা ফলস থেকে লাফিয়ে পড়েছেন, এবং... বেঁচে ফিরেছেন। তাই তো ইতিহাসের পাতায় তিনি স্বর্ণাক্ষরে পরিচিত হয়ে আছেন 'দ্য কুইন অভ দ্য মিস্ট' নামে।

কুইন অভ মিস্ট অ্যানি টেইলর

চলুন জেনে নিই অ্যানি ও তার অবিশ্বাস্য স্টান্টবাজির ব্যাপারে মজার দশটি তথ্য। 

১/ পেশাজীবনে অ্যানি ছিলেন একজন শিক্ষিকা। হ্যাঁ পাঠক, ঠিকই পড়েছেন। বাচ্চাকাচ্চাদের যিনি শিক্ষাদান করেন, কল্পনা করে নেয়াই স্বাভাবিক যে তিনি কিছুটা ধীরস্থির, শান্ত স্বভাবেরই হবেন। কিন্তু অ্যানি ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের অধিকারী। না হলে কি আর কেউ এমন অসম্ভব কাজ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে? তাও আবার নায়াগ্রা ফলস থেকে! 

২/ যে পিপেটিতে করে অ্যানি লাফ দিয়েছিলেন, সেটি তিনি নিজেই নকশা করে বানিয়েছিলেন। পাঁচ ফুট লম্বা ও তিন ফুট চওড়া পিপেটির ওজন ছিল প্রায় ২০০ পাউন্ডের মত। পিপের ভিতরে কুশন লাগিয়ে নিয়েছিলেন অ্যানি, যাতে ঝাঁকুনিতে বড় ধরণের কোন আঘাত তিনি না পান। 

৩/ অ্যানি কিন্তু নিজেই প্রথম লাফ দেননি। তার এই এক্সপেরিমেন্ট আদৌ কতটুকু সাফল্যের দেখা পাবে, এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন তিনি। তাই গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন নিজের বিড়ালটিকে। শুধু বিড়ালটিকে পিপেতে করে ছুঁড়ে ফেলার পরও যখন বিড়ালটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় জানে বেঁচে যায়, তখন নিজেও কাজটি করে দেখাবার সাহস সঞ্চার হয় অ্যানির মনে। 

৬৩ বছর বয়সে তিনি এ কাজটি করেন

৪/ নিজের এই স্টান্টের ব্যাপারে যখন অ্যানি প্রচারণা চালান, তখন বেশ বড়সড় একটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। সবাইকে বলে বেড়িয়েছিলেন, তার নাকি তখন মাত্র ৪০ এর কিছুটা বেশি বয়স চলছে। আদতে তার তখন ৬৩ বছর বয়স। অবশ্য বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক ছিল। এত বয়স্ক একজন নারী এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছেন জানতে পারলে তাকে বাঁধা দেয়ার লোকের নিশ্চয়ই অভাব পড়ত না!  

৫/ পুরো স্টান্টটি করে দেখাতে অ্যানির সময় লেগেছিল মোট ২০ মিনিট। ২৪ অক্টোবর বিকাল চারটার দিকে তিনি পিপেতে প্রবেশ করেন। আর বাকিটা তো ইতিহাস! 

৬/ স্টান্টটি সম্পন্ন করার পর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অ্যানির কয়েকদিন সময় লেগেছিল। এবং অবশেষে যখন তিনি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসেন, শুরুতেই একটি বিশাল বড় ধাক্কা খান। কেননা যেই পিপেটিতে করে তিনি লাফ দিয়েছিলেন, তার ম্যানেজার সেটি চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যায়। আজ যদি সেই পিপেটি থাকত, তার ঐতিহাসিক মূল্য যে কত বেশি হতো তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া এটি হতে পারত অ্যানির বাকি জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় সুখস্মৃতি। তাই পিপেটি উদ্ধার করতে তিনি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরও নিয়োগ দেন। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর পিপে বা ম্যানেজারের টিকিটারও দেখা পায়নি। 

৭/ আপাত অসম্ভব স্টান্টটি করে দেখানোর পর কয়েক মাস অ্যানিকে নিয়ে বেশ ভালোই শোরগোল পড়ে যায় চারিদিকে। বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন অ্যানি, এবং তা হয়েও ছেড়েছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনে এই খ্যাতি তার বিশেষ কোন উপকারে আসেনি। কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেকে প্রায় সর্বশান্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন তিনি। এবং প্রচন্ড দারিদ্র্যের মাঝেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয় তাকে। 

৮/ অ্যানির এই কাজ যে শুধু সমাজেই তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল, এমনটি ভাবলে খুব বড় ভুল হবে। তার এই স্টান্টবাজি যুক্তরাষ্ট ও কানাডার সরকারের উপরমহলেও নাড়া দিয়েছিল। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ধরণের কোন 'ছেলেমানুষি স্টান্ট' দেখাতে না পারে, এ জন্য বিশেষ আইনও প্রণয়ন করা হয়েছিল। অবশ্য স্টান্টবাজরা তাতে থোড়াই কেয়ার করেছিল। শিকারী বাঘ একবার রক্তের সন্ধান পেলে তাকে কি আর থামিয়ে রাখা সম্ভব! 

৯/ অ্যানির করা স্টান্ট দেখে যে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, তা তো আগেই বলেছি। কিন্তু তার মত একই রকম কাজ আরও একবার করে দেখাতে সময় লেগেছিল পুরো দশ বছর। ১৯১১ সালে ববি লিচ নামে এক লোক দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই কাজটি করে দেখান। অবশ্য অ্যানির মত তিনি কাঠের পিপে নয়, ব্যবহার করেছিলেন স্টিলের পিপে। ১৯১১ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে মোটামুটি ১৫ জন ব্যক্তি অ্যানিকে অনুকরণের চেষ্টা করেছিলেন। এর মধ্যে প্রাণে বেঁচেছিলেন মাত্র ১০ জন। 

১০/ নিছকই কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন অ্যানি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার বন্ধুরা মিলে টাকা তুলে যথাযথভাবে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান পালনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং অ্যানিকে কবর দেয়া হয় নায়াগ্রা ফলসের একদম কাছের গোরস্থানেই। এখন চাইলেই নায়াগ্রা ফলসে ঘুরতে যাওয়া যে কোন দর্শনার্থী এক নজর অ্যানির কবরটি দেখে আসতে পারেন।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা