"আমি পাহাড় জানি না, তবে সাগর চিনি। আই অ্যাম ফ্যামিলিয়ার উইথ ওশান"। তার মুখে এমন কথা দাম্ভিকতা শোনায় না মোটেও, কেননা তিনি নৌকা বেয়ে একা একা পাড়ি দিয়েছেন দুটি মহাসাগর একটি সাগর!
১৯৬৬ সালে, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে, ফ্রান্সের উপকূলবর্তী শহর কুইনপেরের এক নাবিক পরিবারে জন্ম মেয়েটির। নাম তাঁর অ্যান কিউমেরে। তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় কিউমেরে ছোটবেলা থেকেই বাবার হাত ধরে সমুদ্রে যেতেন। সেই থেকে সখ্যতা শুরু সমুদ্রের সাথে, ঠিক যেন বাস্তবের মোয়ানা!
'আমি পাহাড় জানি না, তবে সাগর চিনি। আই অ্যাম ফ্যামিলিয়ার উইথ ওশান'- তার মুখে এমন কথা দাম্ভিকতা শোনায় না মোটেও। কেননা এই মানুষটা নৌকা বেয়ে একা একা পাড়ি দিয়েছেন দুটি মহাসাগর ও একটি সাগর! সর্ববৃহৎ প্রশান্ত মহাসাগর ছাড়াও আটলান্টিক মহাসাগর আর আর্কটিক সাগর নৌকা বেয়ে পাড়ি দিয়েছেন তিনি।
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে ৯০ দশকে তিনি পাড়ি জমান আমেরিকায়, সেখানেই থিতু হন। ট্র্যাভেল ও ট্যুরিজম নিয়ে আমেরিকায় অনেক কাজ করলেও তার মনটা পড়ে থাকে আটলান্টিকের ধারে, যেখানে তিনি তার রঙিন শৈশব কাটিয়েছেন, দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন আটলান্টিক। অতঃপর ৯০ দশকের শেষে এসে তিনি মনস্থির করেন ফ্রান্সে ফেরত যাবেন এবং যে কাজ করতে মন সায় দেয়, তাই করবেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, আটলান্টিক পাড়ি দিবেন নৌকা চালিয়ে।
২০০১ সালে, তাঁর সেই কাঙ্ক্ষিত যাত্রা শুরু হয় আফ্রিকার কাছে ক্যানারি দ্বীপ থেকে। সেখান থেকে বৈঠাচালিত নৌকায় করে একা তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ যান। ক্যানারি দ্বীপ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্যাডেল ও বৈঠাচালিত নৌকা চালিয়ে পৌছুতে তার সময় লেগেছিল ৫৭ দিন! বছর দুয়েক পেরুতেই নিউইয়র্ক থেকে তিনি আবার আটলান্টিকে নামেন। এবার গন্তব্য? নিজ বাড়ি, ফ্রান্স। এই যাত্রায় তার সময় লেগেছিল ৮৭ দিন। একই পথে মার্কিন এক নারী অভিযাত্রীর রেকর্ড ছিল ৮৬ দিনের, অল্পের জন্য রেকর্ডটি ভাঙা হয়নি তাই। তবে রেকর্ড ভাঙতে না পারার আক্ষেপ আর বেশিদিন বয়ে বেড়াতে হয়নি৷
হার না মানা কিউমেরে ২০০৬ সালে আবারও আটলান্টিকে নামেন। এবার আর বৈঠাচালিত নৌকায় নয়, বেছে নিলেন ২ বছর ধরে বানানো কাইট বোট! এই নৌকাটি অযান্ত্রিক হলেও এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- এর ঘুড়ির মতো পাল রয়েছে, যা দ্রুত চলতে সাহায্য করে। নিউইয়র্ক থেকে ফ্রান্স পৌঁছাতে যেখানে আগেরবার সময় লেগেছিল ৮৭দিন, এবার সেই একই যাত্রাপথে তার সময় লাগলো ৫৫ দিন। কাইট বোটের যাদু এবং আন কুইমেরের মন্ত্র- দুইয়ে মিলে গড়লো নতুন রেকর্ড!
অ্যাডভেঞ্চারকে যেহেতু জীবনের মূল বিষয় করে নিয়েছেন, তাই থেমে থাকার প্রশ্নই আসে না কিউমেরের। ২০০৬ এ রেকর্ড গড়ার পর তিনি যেন আরও উজ্জীবিত হলেন, সাহস বেড়ে গেল কয়েক গুণ। ২০০৮ সালে তাই তিনি লক্ষ্য হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরকে বেছে নিলেন, যাত্রাপথ শুরু যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকো থেকে। কিন্তু বাধা ছাড়া কোনো কঠিন জয় কি আসে? না! এবার প্রথম দফায় ব্যর্থ হলেন তিনি। প্রশান্তকে জয় করতে গিয়ে নিজের জীবনটাই হারাতে বসেছিলেন তিনি, আটকে পড়েছিলেন মধ্যসাগরে। প্রায় এক মাস আটকা থাকার পর একটি কার্গো জাহাজ এসে উদ্ধার করে তাকে৷
প্রশান্ত মহাসাগরে তিনি আবারও নামেন ২০১১ সালে। এবারের গন্তব্য পেরু থেকে তাহিতি দ্বীপ। সঙ্গী হিসেবে সেই পুরোনো কাইট বোট। যাত্রাপথের সাত হাজার কিলোমিটার পথ তিনি পাড়ি দেন ৭৮ দিনে। সাধারণত যাত্রাপথে মুঠোফোন ব্যবহার করেন না তিনি, সাথে থাকে কৃত্রিম উপগ্রহনির্ভর স্যাট ফোন। কিন্তু ৭৮ দিনের যাত্রার এক সপ্তাহের মাথায়ই সে ফোনটি ভেঙে যায়, কারিগরি দলসহ অন্যান্য সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে ৭০ দিন। তার ভাষায় সেই দিনগুলো ছিল, 'সত্যিকারের একাকীত্ব'।
প্রতিটি যাত্রায় তিনি রুটিন মেনে নৌকা চালান। তা হলো- টানা ছয় ঘন্টা বৈঠা বাওয়ার পর তিন ঘন্টা খাওয়া, বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য বিরতি রাখেন তিনি। ছয় ঘন্টা-তিন ঘন্টার রুটিন মেনে তিনি ভাসতে থাকেন সাগর থেকে সাগরে, দিনের পর দিন। কিন্তু কাইট বোটের বেলায় সেই রুটিন পরিবর্তন হয়ে দাঁড়ায় আট ঘন্টা-চার ঘন্টায়। কেননা সন্ধ্যার পর কাইট বোট চালানো কঠিন হয়ে পরে। যাত্রাকালীন সময়ে খাবার হিসেবে কিউমেরে শুকনো খাবার সঙ্গে নেন, আর সমুদ্রের পানিকে সুপেয় করবার ব্যবস্থা তো সাথে থাকেই৷
অযান্ত্রিক সব ধরণের নৌকাই ব্যবহার করেন তিনি। ২০১৯ সালে দক্ষিণ মেরুর আর্কটিক সাগরও পাড়ি দেন তিনি, সাথে নিয়েছিলেন সৌরচালিত নৌকা। এইবার যাত্রাপথ ছিল আলাস্কা থেকে গ্রিনল্যান্ডের একেবারে উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত। এখানেও তিনি রেকর্ড গড়েছেন।
দারুণ সাহসী এই অভিযাত্রী গত ১১ থেকে ১৫ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু জাতীয় এডভেঞ্চার উৎসবে বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশে এসে কাপ্তাই হ্রদেও তিনি কায়াকিং করেছেন, বাংলাদেশের আতিথেয়তায় হয়েছেন মুগ্ধ। ঢাকায় 'প্রথম আলো'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যেকোনো দেশেই নারীর পক্ষে অ্যাডভেঞ্চার করা সহজ নয়। আমি যখন শুরু করি, তখন আমার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা আমার বাবাকে বলতেন, কী দরকার মেয়ের এভাবে অভিযানে যাওয়া? এটা তো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তার চেয়ে পড়াশোনা করুক, ঘর–সংসার করুক।’ কিন্তু অ্যান সহজ সেই পথে না গিয়ে বেঁছে নিয়েছিলেন বন্ধুর পথ।
৫৪ বছর পূর্ণ করতে যাওয়া এই অভিযাত্রীর কাছে বয়স শুধুই একটি সংখ্যা, বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে ফিরেই আবারও জিম শুরু করেছেন নিয়মিত। তারুণ্যে ভরপুর এই নারী মাস ছয়েকের মধ্যে আবার নতুন কোনো অভিযানে বেরোবেন। কে জানে, হয়তো গড়বেন নতুন কোনো রেকর্ড!
তথ্য কৃতজ্ঞতা- প্রথম আলো