অঞ্জনযাত্রা: পাগলাটে, খ্যাপাটে, অথবা নিপাট-সরল এক অঞ্জন দত্তের গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

'অঞ্জনযাত্রা' বইটিতে উঠে এসেছে এমন সব বিস্ফোরক তথ্য ও ঘটনা, যেগুলো প্রকাশ্যে বলার আগে যেকোনো মানুষ দুইবার ভাববেন। কিন্তু, অঞ্জন দত্ত ঠিক এখানেই আলাদা। তিনি বলে গেলেন জীবনের সব। যেগুলো বলা যায়, সেগুলো। যেগুলো বলা যায় না, সেগুলোও।
বইটি নিয়ে আমার অদ্ভুত কিছু স্মৃতি আছে। চট্টগ্রামের বাতিঘরে এ বইটা যেদিন আসে, সেদিন আমিই প্রথম বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম। মলাট দেখেছিলাম। কেন যেন ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো আর দেখিনি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বইয়ের টার্গেট নিয়ে গিয়েছিলাম বাতিঘরে। সেটা বদলদাবা করে চলে এসেছিলাম সেদিন। এ গল্পের এখানেই ইতি।
এরপর অনেক অনেক মাস পর, সেদিন ঢুকলাম রকমারির ওয়েবসাইটে। স্ক্রল করে দেখি 'অঞ্জনযাত্রা'র মলাট। কী ভেবেই 'কুইক রিড' অপশনটা ক্লিক করলাম। ৭-৮ পৃষ্ঠা পড়ার পরেই আমার মনে হলো, এ বই আমার পড়তে হবে। যেভাবেই হোক।
পরদিনই চলে গেলাম চট্টগ্রামের বাতিঘর। দরজা দিয়ে ঢুকেই সোজা সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, বইটা আছে? বললো, আছে। প্রাণে জল চলে এলো। এরপর আধাঘন্টা ধরে খুঁজে এসে জানালো, বইটা নেই। কবে আসবে? জানে না তারা৷
আমি এই বইয়ের যে প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান, তাদের সাথেও কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না তাদের দিক থেকে। ওদিকে আমিও তখন নাছোড়বান্দা। এ বই আমাকে জোগাড় করতেই হবে। শেষ কবে কোন বইয়ের জন্যে এভাবে মরিয়া হয়েছিলাম, জানি না। অনলাইনের কোনো বুকশপেই এই বইটা নেই। খুব একটা নাম করে নি বইটা। বাই দ্য ওয়ে, পিডিএফও খুঁজেছিলাম আর কিছু না পেয়ে। তাও পাইনি।
এরপর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলাম। সরাসরি গেলাম ঢাকার বাতিঘরে। ঢুকেই আঁতিপাঁতি খোঁজা শুরু করলাম। সমারসেট, সমরেশ, সুনীল, হুমায়ূন, হারুকি মুরাকামি সবাইকে উপেক্ষা করে আমি খুঁজছি সাজ্জাদ হুসাইন নামের এক মানুষের বই, যে বইয়ের নাম 'অঞ্জনযাত্রা।' পেলাম না। নিরাশ। এরপরে সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, বইটা আছে? সে জানালো, আছে। চট্টগ্রামের বাতিঘরের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সেলসম্যানের এ কথায় সন্তুষ্ট হওয়া ঠিক হবেনা। আমাকে প্রাচীন অশ্বত্থের মতন দাঁড় করিয়ে সেলসম্যান চলে গেলো বই আনার জন্যে। আমি দলের শেষ ব্যাটসম্যান হয়ে প্রতিপক্ষের আউটের আবেদনে থার্ড আম্পায়ারের স্ক্রিনের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার মত স্থির। স্থানু৷
আমি ভাবলাম, লোকটি খালি হাতেই ফিরবেন। দেখি, হাতে সাদা মলাটের বেশ গাব্দাগোবদা এক বই নিয়ে ফিরছেন তিনি। হাত বাড়িয়ে বইটা নেয়ার পর দেখলাম, সাদা মলাটে সোনালী রঙে চকচকে হরফে লেখা 'অঞ্জনযাত্রা।' সাথে অঞ্জন দত্তের স্টিল। বইটা হাতে নেয়ার পর আমি কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই রইলাম। এই সেই বই, যার জন্যে এত দৌড়ঝাঁপ! প্লাস্টিকের কাভার টা খুলে বই পড়া শুরু করলাম। বাতিঘরে বসেই। তখনই।
এবার যা বলবো, সেটা বই পড়ে আমার উপলব্ধি। এবং দেড় হাজার টাকা মূল্যের বেশ দামী এ বই এত যে দৌড়ঝাঁপ করে সংগ্রহ করেছি, সেটা আসলেই আমার প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে কী না, সে প্রশ্নেরও উত্তর থাকবে। প্রথমেই এটা জানিয়ে রাখি, অঞ্জন দত্ত আমার প্রিয়। ছোটবেলা থেকে অঞ্জন, সুমন, নচিকেতার গান শুনে শুনেই বড় হয়েছি। এখনো শুনি। কিন্তু অঞ্জন অতটাও প্রিয় না যে, তাঁর আত্মজীবনী জোগাড় করার জন্যে এতটা পাগলামি করবো। তবে এই আত্মজীবনী প্রথাগত আত্মজীবনী না। ঠিক সেখানেই আমার আগ্রহ। অনেকটা সাংবাদিক সাজ্জাদ হুসাইনের প্রশ্ন আর অঞ্জন দত্তের উত্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে পুরো বিষয়টা। পুরো জার্নিটা। তবে সেই প্রশ্নগুলো ঠিক অর্থোডক্স, টিপিক্যাল প্রশ্নও না। বেশ থট প্রভোকিং প্রশ্ন সেগুলো।
অঞ্জন দত্তের ছোটবেলা শুরু হয়েছে দার্জিলিং এর সেন্ট পলস' স্কুলে। অঞ্জন দত্ত'ও তাঁর আত্মজীবনী বলার জন্যে সাজ্জাদ হুসাইনকে নিয়ে গেলেন দার্জিলিং। সেই মেঘ, কুয়াশা, পাহাড় আর দার্জিলিং টি... ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো স্মৃতি। এ বই পড়তে পড়তে কোথায় যেন আমি নিজেও পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং। 'হোটেল নির্ভানা'তে দুই রাত ছিলেন সাজ্জাদ হুসাইন ও অঞ্জন দত্ত, এদের পাশের কামরাতে যেন উঠে গেলাম আমিও। কান খাড়া করে আড়ি পেতে এদের কথা শুনবার জন্যে।

এ বইতে ঠিক বিখ্যাত অঞ্জন দত্তের গল্প উঠে আসেনি। উঠে এসেছে এক প্রচণ্ড সংগ্রামী মানুষের গল্প। যিনি হতে চেয়েছিলেন অভিনেতা। ভেবেছিলেন, দুনিয়াকে বদলে দেয়ার মতন অভিনয়-দক্ষতা আছে তার। যে মানুষটি মৃণাল সেনের সিনেমায় মেথড অভিনয় করার সময়ে রক্ত-ডায়রিয়া হয়ে হাসপাতালে বেঘোরে পড়েছিলেন। যে মানুষটি অপর্ণা সেনের ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিলেন সমুদ্রে। সাঁতার না জেনেই যিনি ক্যামেরাকে পেছনে রেখে চলে গিয়েছিলেন সমুদ্রে, শুধুমাত্র লাস্ট সীনটাকে অসাধারণ করার জন্যে। অর্জুনের মতন পবিত্র প্রতিজ্ঞা ছিলো তাঁরও৷ কিন্তু কী পেলেন?
প্রথমদিকে ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। মানুষজন হাততালি দিয়েছে। ঐ যা। অভিনেতা হিসেবে ঠিক 'শক্তিমান অভিনেতা'র খেতাব টা আর পাওয়া হয়নি। এরপর এলেন পরিচালনায়৷ অভিনয়ের অতৃপ্তি ঘোচাতেই হয়তো। পরিচালক হিসেবেও খুব যে ভাংচুর রকমের কাজকর্ম করলেন তাও না। তবু এ মানুষটি না অভিনয়, না পরিচালনা... একটিও ছাড়লেন না। এখনো 'সাহেব বিবি গোলাম' এর ঠাণ্ডা স্বভাবের শ্যুটার বা 'নির্বাক' এর প্রচণ্ড নার্সিসিস্ট লোকটির চরিত্রে দেখা যায় তাকে। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, তিনি ভালো অভিনেতা। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, তিনি অনেক কিছুই দিতে পারতেন ইন্ডাস্ট্রিকে। কিন্তু কেউ তাকে ব্যবহার করেন নি। তিনি এখনো 'আবার আসবো ফিরে' সিনেমার প্রমোশনে ব্যস্ত সময় পার করেন৷ মার্কেজের মতন তার ঝুলিতেও অজস্র গল্প। যেগুলো তিনি বলতে চান সবাইকে৷ ক্যামেরার কলমে।
আমি আত্মজীবনী কম পড়িনি। কিন্তু এরকম খোলামেলা, সোজাসাপটা কথাবার্তা খুবই কম পড়েছি যেকোনো আত্মকথনে। ঋতুপর্ণ ঘোষ নিয়ে সরাসরিই বলেছেন-
ঋতু আমার ভালো বন্ধু। কিন্তু ওর মেয়েলিপনার আদিখ্যেতা ভালো লাগে না। ও যে সমস্ত সিনেমা করেছে, সে সব সিনেমার গল্প আগেই অন্যান্য পরিচালকেরা বলে গিয়েছেন। আমি ওর সিনেমাতে নতুন কিছু পাইনি।
সৃজিতের সিনেমা নিয়েও সোজাসাপ্টা কথা-
ওর সিনেমা অনেকগুলো খুবই গতানুগতিক। আমার ভালো লাগেনি একটুও। তবে দুয়েকটা ভালো কাজও হয়েছে। সেগুলো আমি ওকে বলেছিও।
নচিকেতার গান নিয়ে বলেছেন-
ওর গান আমাকে ভাবায় না। আমাকে ভাবায় সুমনের গান। নচিকেতার গান প্রচণ্ড নীতিকথামূলক। শিল্পের জায়গাটা খুব মিসিং।
প্রসেনজিৎ কে নিয়ে বলেছেন-
ওকে আমি কোনো সিনেমায় নেইনি। কারন ওর রোলগুলো বড্ড একঘেয়ে।
অঞ্জন জানেন, তার এ বইটি বের হলে অনেকেই পড়বেন। যে মানুষগুলোকে নিয়ে এসব ঋণাত্মক কথা বলেছেন, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ পড়বেন। তবুও তিনি মানুষগুলো নিয়ে নিজের মনের কথা অকপটে বলেছেন বইটিতে। কোনো লুকোছাপা নেই। সাদাসিধে কিশোরের মতন ভেতরের সব বলে দিয়েছেন। বলবেন নাও বা কেন? বড় হয়েছেন দার্জিলিং এ, বড় হয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছোঁয়া দূরত্বে। মেঘ মাখানো পাহাড়ের মতন বিশালতা ও স্বচ্ছতা যে তার চরিত্রে থাকবে, এটাই কাম্য।
বলেছেন ছোটবেলার বন্ধুদের কথা। মোশাই গ্যাং এর কথা। যাদের সাথে মিশে প্রথম বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা খাওয়ার হাতেখড়ি। বলেছেন স্কুলের সেই ম্যাডামের কথা, যাকে ভালোবেসেছিলেন তিনি মনপ্রাণ দিয়ে। বলেছেন সেই বন্ধুর কথাও, স্যারের বেতের ঘা খাওয়ার পরে যে বন্ধু সিগারেট দিয়ে বলেছিলো-
এটায় টান দাও কয়েকটা। ব্যথা কমবে।
এসেছে সেসব বন্ধুদের কথাও, যারা আজ আর নেই। তবুও অঞ্জনের ভেতরে কোথাও যেন তারা আছেন। মেলা থেকে কেনা খেলনা যেমন বাচ্চারা আগলে রাখে পরম মমতায়, অঞ্জনের ভেতরেও ঠিক তেমনিই আছে এই বন্ধুরা।
অভিনেতা হিসেবে অঞ্জন যতটা অসফল, গায়ক হিসেবে ঠিক ততটাই যেন সফল এই মানুষ। ভক্তদের উন্মাতাল পাগলামি, প্রত্যেকটা গান হিট হওয়া... অঞ্জন হয়তো গায়ক হিসেবে পেয়েছেন প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। কিন্তু কোথায় যেন তিনি খুশি হন না। তিনি তো হতে চেয়েছিলেন অভিনেতা। সেটাই আর হয়নি এ জীবনে। তবে এটাও তো ঠিক, যে গান তিনি গেয়েছেন, সে গানের চরিত্রগুলোকে তিনি করে দিয়েছেন অমর। নিজে স্বীকারও করেছেন, বেলা বোস, রঞ্জনা, মেরী অ্যান… দেখেছেন প্রত্যেককেই। প্রত্যেকটা গান তাই বাস্তব, সত্য, পবিত্র।

অঞ্জন দত্ত কথা বলেছেন নারী, পুরুষ, প্রেম, যৌনতা, আত্মা, ঈশ্বর, বিশ্বাস, অবিশ্বাস... সব নিয়েই। এবং প্রশ্নগুলোও ঠিক অতটা প্রথাগত প্যানপেনে প্রশ্ন না। অনেকটা চাঁছাছোলা প্রশ্ন। যেমন একটা প্রশ্ন এরকম ছিলো-
বিয়ের আগে শারিরীক সম্পর্কে জড়িয়েছেন?
অদ্ভুত ব্যাপার, অঞ্জন দত্ত সেগুলোরও উত্তর দিয়েছেন। কোনোরকম ভনিতা, কোনোরকম দোটানা না করে। যা সত্যি, যা তিনি বিশ্বাস করেন, সেগুলোই বলে গিয়েছেন তিনি। এতে করে যেটা হয়েছে, মানুষ হিসেবে অঞ্জন দত্ত'কে বুঝতে সুবিধে হয়েছে আমার। প্রত্যেকটা প্রশ্ন এবং সেগুলোর উত্তর যেন তিলে তিলে গড়ে দিয়েছে রক্ত-মাংসের মানুষটিকেই।

কলকাতার বাঙ্গালী মহল অঞ্জন দত্তকে ঠিক পছন্দ করে না। অঞ্জন দত্তও তাদের পছন্দ করেন৷ না। তিনি ঠিক প্রথাগত 'মাছে-ভাতে'র বাঙ্গালী ননও। সাহেবদের স্কুলে পড়েছেন। বাড়ির পরিবেশেও ছিলো সাহেবী কায়দার অস্তিত্ব। তাই তিনি মাছ-ভাতের বদলে শান্তি পান ওয়াইন-হুইস্কিতেই। একটা সময় ঠিকঠাক বাংলাও বলতে পারতেন না। ব্যোমকেশ-ফেলুদা-কাকাবাবু-পরাশর বর্মা পড়ে বাংলাকে ঠিক করেছেন। তিনি এখনো পূজার প্যান্ডেলের বদলে বেশি স্বাচ্ছন্দ পান চার্চের কাঠের বেঞ্চিতে। অঞ্জন দত্ত এরকমই। তিনি ওগুলোকে গুরুত্ব দেনও না, কে তাকে কী ভাবছে বা না ভাবছে। তিনি কাউকে বলেনও না, তিনি ঠিক কী ভুল। তিনি তাঁর মত করেই এগিয়ে যান নিজের মত। স্ত্রী ছন্দা, যিনি নিজে তার অভিভাবকের মতন আর একমাত্র সন্তান নীল, যে আবার অঞ্জনের বন্ধুর মতোন... এদের নিয়েই অঞ্জনের পাগলামো, খ্যাপাটেপনা, আবেগে ভেসে যাওয়া।
এ বই আমার জন্যে ছিলো এক অদ্ভুত নিরিবিলি আধ্যাত্মিক যাত্রার মতন। বইয়ের নামটাও তো 'অঞ্জনযাত্রা'। 'অঞ্জনযাত্রা'র প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা অক্ষর, প্রত্যেকটা রঙ্গিন ছবি আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়েছি। 'অঞ্জনযাত্রা' শেষ করার পরে তাই মনে হয়েছে, যাঃ শেষ হয়ে গেল! আর কিছু নেই?
৩৩১ পৃষ্ঠার এ বইয়ের দাম যেটাই হোক না কেন, এক প্রচন্ড খামখেয়ালি মানুষের জীবনকালের যে তথ্য পেলাম দার্জিলিং এর মেঘের নীচের ম্যালচত্ত্বরে বসে শীতে কাঁপতে কাঁপতে, সে বর্ণনাতীত। অসাধারণ প্রিয় হয়ে মেঘ আর কুয়াশার মাকড়সা-জাল মাখিয়ে বুকশেলফের উষ্ণ ওমেই রয়ে গেলো তাই বইটা।
সারাজীবনের জন্যে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন