তিন ঘন্টার পরীক্ষা দুই ঘন্টা লিখে বেরিয়ে এলাম, বাইরে চিন্তিত মুখে মা বসে আছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সব কিছু ঠিকঠাক লিখেছো? আমি বললাম, না মা, চৌত্রিশের উত্তর করে এসেছি। মা বললেন, পাশ কততে? আমি বললাম, তেত্রিশ। তোমার ফুঁ’তে আর কাজ হবে না মা।
আনিসুল হক- একটা নাম, একটা ইতিহাস। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, দায়িত্ব প্রাপ্তির পরে যিনি ঢাকাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সবুজ এক নগরী হিসেবে, বসবাসযোগ্য নগরীর তালিকায় ঢাকার স্থান থাকবে ওপরের দিকে- এই ছিল যার স্বপ্ন, সেই মানুষটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে, হারিয়ে গিয়েছেন অজানার দেশে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপস্থাপক থেকে শুরু করে সফল ব্যবসায়ী, তারপর সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটা অবস্থান থেকে এসে ঢাকার মেয়র নির্বাচিত হওয়া আর জনবান্ধব কার্যক্রম পরিচালনা করে মানুষের মনে চিরস্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়া- এটাই সংক্ষেপে আনিসুল হকের কর্মজীবন।
ব্যক্তিগত আর পেশাগত জীবনে দারুণ সফল এই মানুষটা বিভিন্ন সময়ে নানা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন, তার বক্তব্যে উঠে এসেছে এই সময়ের তরুণদের করণীয় সম্পর্কে। সবাইকে তিনি শুনিয়েছেন নিজের জীবন সংগ্রামের গল্প, জানিয়েছেন তার সাফল্যের পেছনে তার মায়ের কতখানি অবদান ছিল। এগিয়ে চলো’র পাঠকদের জন্যে তুলে ধরা হলো সেসব বক্তব্যের চুম্বক অংশ।
"আমার জীবন আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই শুরু হয়েছিল, আমি অনেক বড় কিছু হয়ে গেছি, সেটা ভাবার কোন কারণ নেই। তবুও জীবনযুদ্ধে চলতে চলতে এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে কেউ কেউ হয়তো আমাকে চেনে, কিছু প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার আমার ওপরে। মধ্যবিত্ত বাবা একটা চাকুরী করতেন। একটা সময় ছিল, যখন তিনি ভাবেনইনি যে সব ছেলেকে পড়ালেখা করাতে পারবেন।
চার ভাই এক বোন আমরা। পড়াশোনা করেছি, ইকনোমিক্সে অনার্স-মাস্টার্স করেছি, কিন্ত জীবনের অনেকগুলো বছর বেকারও থাকতে হয়েছে। আমাদেরকে হাত ধরে তোলার কেউ ছিল না, আমরা নিজের মতো করে এগিয়েছি, ঠেকেছি, শিখেছি। আর এই জীবনের পথচলায় অনেক এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে। জীবনকে এখন বেশ খানিকটা উপর থেকে দেখতে পারি, সেখানে থেকেই তোমাদের বলি, তোমাদের চেয়ে খুব উন্নত জীবন নিয়ে আমরা শুরু করিনি।
যাদেরকে তোমরা রোল মডেল হিসেবে ভাবো, তাদের কেউই স্বর্ণের চামচ মুখে নিয়ে আসেনি, তারা নিজেদের পরিশ্রমে তাদের জীবনকে গড়ে নিয়েছে। জীবনকে গড়ার জন্যে যুদ্ধ করেছে। যে আনিসুল হক তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলে, সেই আনিসুল হকের চেয়ে ভালো জায়গায় যাওয়ার সামর্থ্য তোমাদের প্রত্যেকের আছে। জীবনে চলতে গেলে জীবনের সঙ্গে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হয়। কত দ্রুত কোথায় যাবে সেটি বড় কথা নয়। আমাকে কালকেই পৌছাতে হবে, কালই অস্কার জয় করতে হবে- এটা ভুল ধারণা। কোথায় যাবে সেটা আগে ঠিক করো। সেই যাত্রাপথে নিজের স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করো। সেই পথটা কখনোই সুমধুর নয়।
জীবনে সাফল্য অর্জনের পথে প্রত্যেকটা মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটা কি জানো? সেটা হচ্ছে মায়ের দোয়া। সেই মা আমার মা, সেই মা তোমার মা, সেই মা সবার মা; সব মায়ের এক চেহারা। সেই মা যতো শিক্ষিত হোক, যতো অশিক্ষিতই হোক, তার একটিই আরাধ্য ধন, তার সন্তান। আমি নিশ্চিত করে বলবো, যেকোন পরিস্থিতিতে বলবো, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল আমার মায়ের দোয়া।
যেখানেই যাই, আমার একটা নেশা ধরে যায়, মায়ের গল্প বলা। দুজন মায়ের গল্প আমি সবসময় বলি, একজন সনাতনী এক সাধারণ মা, আরেকজন মা অদ্ভুত, অসাধারণ একজন। উনিশশো একাত্তরের আগস্টে আজাদ বলে একটি ছেলে ধরা পড়েছে পাকিস্তানীদের হাতে, মুক্তিযোদ্ধা ছিল সে। রমনা থানায় নেয়া হয়েছে তাঁকে, তার মাকে খবর পাঠানো হয়েছে, ছেলেকে মুক্ত দেখতে চাইলে যাতে তাকে সত্যি কথা বলতে বলে।
সেই মা ছুটে গেছে রমনা থানায়, জেলখানার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, সন্তানকে জড়িয়ে ধরতে পারেন না তিনি। ছেলে বলে, মা, কাল আসার সময় ভাত নিয়ে এসো, তিনদিন ধরে ভাত খাই না। পরদিন মা এটা সেটা রান্না করে নিয়ে গেছেন জেলে, গিয়ে দেখেন ছেলে তার নেই। সেই ছেলেকে আর পাওয়া যায়নি, সে আর ঘরে ফেরেনি কোনদিন। মা মারা গেছে পনেরো বছর পর। এই পনেরো বছর সেই মা এক দানা ভাত মুখে দেয়নি। ছেলেকে জেলখানার শক্ত মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখেছিলেন, মা তার বাকী জীবন কখনও খাটে শোননি, মাটিতে শুতেন। এই হলো মা।
আমার মায়ের গল্পটা বলি। আমার মা খুব একটা শিক্ষিত ছিলেন না। আমার কিছু হলেই আমি মায়ের কাছে গিয়ে বলতাম, “আমার গায়ের ওপর একটা পা রাখো তো, আর আমাকে একটা ফুঁ দাও!” আমার জীবন এখনও ফুঁ’য়ের ওপর চলছে। আমি যখন মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি, একটা পরীক্ষার আগে আমার খুব জ্বর, একশো চার ডিগ্রী হবে। সকালবেলা উঠে আমি বললাম, মা, আমি তো পরীক্ষা দিতে পারবো না। মা বললেন, এটা কি হয় নাকি রে বাবা, পরীক্ষা না দিলে তুমি এক বছর পিছিয়ে যাবে না? আমি বললাম, আমার তো কোন উপায় নেই, আমি চোখে কিছু দেখছি না। উনি অনেক দোয়াটোয়া পড়ে আমাকে ফুঁ দিলেন, আমার হাত ধরে বললেন, চলো যাই।
তিন ঘন্টার পরীক্ষা দুই ঘন্টা লিখে বেরিয়ে এলাম, বাইরে চিন্তত মুখে মা বসে আছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সবকিছু ঠিকঠাক লিখেছো? আমি বললাম, না মা, চৌত্রিশের উত্তর করে এসেছি। মা বললেন, পাশ কতোতে? আমি বললাম, তেত্রিশ। তোমার ফুঁ’তে আর কাজ হবে না মা। উনি বললেন, কাজ না হোক, এবার নামাজ পড়ে একটা ফুঁ দেই। মা সেখানে নামাজ পড়লেন দুই রাকাত, তারপর ফুঁ দিলেন সারা গায়ে। হয়তো এটা একটা কাকতালীয় ব্যপার হতেই পারে, কিন্ত পরীক্ষায় আমি চৌত্রিশে চৌত্রিশই পেয়েছিলাম!
এখনও কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে আমি মায়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। মেয়র নির্বাচন করার প্রস্তাব যখন আমাকে দেয়া হলো, আমি খুবই বিপদে পড়ে গেলাম। এত কঠিন একটা কাজ আমাকে দিয়ে হবে কিনা, এসব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার বাবার বয়স পঁচানব্বই, বাবাকে গিয়ে বললাম, বাবা, কি করবো? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চান যে আমি মেয়র হই। বাবা বললেন, “তোমার মায়ের কাছে যাও। মায়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াও, নিজেই বুঝতে পারবে কোনটা করা উচিত।” এটা একটা শক্তি, অন্যরকম একটা শক্তি। মানুষকে সাহসী করে তোলে।
মায়েদের গল্প শেষ, এবার জীবনের গল্প বলি। টাকার পেছনে তো আমরা ছুটি, সবাই ছোটে। কিন্ত টাকা দিয়ে চরিত্র কেনা যায় না, বিশ্বাস কেনা যায় না, টাকা দিয়ে মর্যাল কেনা যায় না, ম্যানার্স কেনা যায় না। টাকা দিয়ে ক্লাসি হওয়া যায় না, টাকা দিয়ে ইন্টেগ্রিটি ডেভেলপ করা যায় না। টাকা দিয়ে প্রেম-ভালোবাসাও কেনা যায় না। সুতরাং, টাকার পেছনে না ছুটে সময়ের পেছনে ছোটো, জীবনের পেছনে ছোটো। আর সময়কে ধরে রাখার জন্যে সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন। লাইফের কোন ব্যাকস্পেস নেই, এর কোনকিছু ডিলিট করা যায় না। একবার সামনে এগিয়ে গেলে তো গেলামই, কম্পিউটারের মতো ব্যকস্পেস দিয়ে আবার ফিরে আসার কোন উপায় নেই।
বলা হয়, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আসলে কখনও কখনও মানুষ তার স্বপ্নের চাইতেও বড়। সেই স্বপ্নকে যদি ধরতে হয়, সেই স্বপ্ন দেখতে হবে, সেটাকে লালন পালন করতে হবে। আজ থেকে ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, তারাও শিক্ষাজীবন শেষ করে বেকার ছিলাম একটা সময়ে। আমিই খুঁজে খুঁজে বেড়িয়েছি যে কি করা যায়। একবার ব্যবসা করি, একবার টেলিভিশনে যাই, একবছর আবার চাকুরী করি। সেই অনিশ্চয়তা তখন যদি থাকে, এখনও আছে। সেটাকে জয় করতে হবে। তোমাদের সামনে সুযোগ আছে, তোমাদের সেই শক্তি আছে, তোমরা চাইলে পৃথিবী জয় করতে পারো।
লোকে আমাকে বড়লোক বলে! অনেকে বলেছিল মেয়র হলে আমি নাকি গরিবের কথা বলতে পারব না। যারা এইসব বলে, ওরা জানে না আমার জীবনের কষ্ট। ওরা জানে না আমার মা কষ্ট করে আমার বাবার প্যান্ট রিফু করে দিতেন, সেই মানুষটা টাকা বাঁচাতে একটা নতুন প্যান্ট কিনতেন না। ওরা জানে না যে আমি বাবার ৬৪ হাজার টাকা নিয়ে জীবন শুরু করতে গিয়ে এক রাতে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম। চার বন্ধু মিলে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, কেউ বাবার থেকে টাকা নিয়ে, কেউ জমানো সঞ্চয় ভেঙে, কেউ জমি বিক্রি করে, কেউবা নতুন বিয়ে করেছে, স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে টাকা এনেছিল। সব মিলিয়ে জোগাড় হওয়া সেই এক লক্ষ চুরানব্বই হাজার টাকা দিয়ে সংগ্রামটা শুরু করেছিলাম। একশো আশি স্কয়ারফিটের একটা রুমে তিন বছর বসে ছিলাম।
আজকে আমরা বন্ধুরা মিলেই প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্রমিকের বেতন দেই। জীবনে অনেক ধরণের ভাঙন আসবে। তোমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছো, দেখবে কোন একসময় হয়তো বাবা পড়ার খরচটা চালাতে পারছে না, হয়তো তুমি নিজে আবিস্কার করবে যে তুমি তোমার নরমাল ট্র্যাক থেকে হারিয়ে যাচ্ছো। সাহসটা হারিয়ে ফেলো না। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আনিসুল হক যদি ঢাকার মেয়র হতে পারেন, তোমরা তো পৃথিবী জয় করতে পারো। ইউ ক্যান উইন দ্য ওয়ার্ল্ড। এন্ড প্লিজ, হ্যাভ ইওর ওন কনফিডেন্স। এই একটি জিনিসই মানুষকে বদলে দেয়।"