বনমানুষের ভাষা: মানুষের সাথে যোগাযোগ কি সম্ভব?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কোকো নামের গরিলাটাকে এক রিপোর্টার সাইন ল্যাংগুয়েজে জিজ্ঞেস করেছিল, "হোয়াট আর ইউ? এনিমেল অর এ পার্সন?" কোকো উত্তর দিয়েছিল, "ফাইন এনিমেল, কোকো।" বিজ্ঞান একদিন নিশ্চয়ই আরও উন্নত হবে, সাইন ল্যাংগুয়েজ ছাড়াই প্রানীর ভাষা বুঝতে পারব আমরা...
ভাষা, মানুষের জীবনে আশীর্বাদের মতন একটা ব্যাপার। এই যে প্রতিনিয়ত কত কথা বলি আমরা, এই যে ভাষার ব্যবহার করে আমি লিখছি, আপনি পড়ছেন। মুখ থেকে উচ্চারণের মাধ্যমে যেসব ধ্বনি বের হয় তা থেকে বিশাল একটা সিস্টেম তৈরী হতে ঠিক কত বছর লেগেছিল? কে জানে? তবে এটা আমার জানা আছে যে লিখিত ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন যে নিদর্শনটি মানুষের হাতে এখন অব্দি ধরা দিয়েছে তা মাত্র ছয় হাজার বছর আগের। মুখে মুখে যে ভাষা, তার জন্ম তো নিশ্চয়ই তারও বহু আগে।
ভাষা নিয়ে কথা বলতে গেলে অন্য প্রাণীর সাথে মানুষের তুলনার ব্যাপারটা আসবেই। ছোটো বেলা থেকে নিরলস পরিশ্রম করে আসছি বিড়ালের ডাকের মর্ম উৎঘাটন করতে, আজও সফল হইনি। প্রাণিকূলের মাঝে মানুষের পরেই বুদ্ধিমান হিসেবে ধরা হয় বানর প্রজাতিকে। আর তাছাড়া বিবর্তন তত্ত্বে ডারউইন সাহেব যে সম্ভাবনা দেখিয়েছেন তা তো ভুলবার নয়। যদিও আমি আমার আদিমাতা হিসেবে হনুমান কিংবা শিম্পাঞ্জিকে কল্পনা করতে নারাজ ( অনুগ্রহ করে কেও আবার 'গোরা' ট্যাগ দিয়ে ফেলবেন না আমায়)।
সে যাই হোক, ব্যাপারটা অনেক বছর ধরেই অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যে বনমানুষদের দিয়ে কথা বলানো সম্ভব কিনা। সম্প্রতি পড়াশোনা করতে গিয়ে অল্পকিছু তথ্য পেলাম। ব্যাস। ভাবলাম লিখে ফেলি। প্রস্তাবনা শেষ, মূল লেখায় ঢুকবো, তার আগে পাঠকদের একটি তথ্য দিতে চাই। ১৯৫০ সালে এক দম্পতি 'ভিকি' নামে এক শিম্পাঞ্জি শাবককে পেলেপুষে বড় করে তুলেন। ভিকি তাদের সন্তানের মতোই ছিল এবং তারাও ওকে কথা বলা শেখানোর চেষ্টাও করেছেন। ভিকি চারটা শব্দ বলতে পারতো, মাম্মা, পাপা, আপ এবং কাপ। লেখার একদম শেষে আবার ভিকির কাছে ফেরত আসা যাবে। আপাতত এটুকুই।
বন্য বনমানুষরা যোগাযোগের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করে সেটাকে বলে 'কল সিস্টেম'। একেক ধরনের আওয়াজ একেকটা মেসেজ দেয়। যেমন ধরুন, একটা বানর গাছের ডালে ঝুলে আছে। তার ক্ষুধা পেয়েছে। পাশের ডালে তার আরেক বন্ধু কলার কাদি নিয়ে বসে আছে। তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সে শব্দ করল, "চি চি"। তার বন্ধু তাকে একটা কলা ছুঁড়ে দিল। এখানে এই "চি চি" হল ক্ষুধা পাওয়ার সংকেত। এরকম কিছু বিশেষ পরিস্থিতির জন্য তাদের বিশেষ কিছু ডাক আছে। তবে এই কল সিস্টেমের গাফিলতি এই যে এর মাধ্যমে একই সাথে দুটো মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। যেমন ধরা যাক, শিকারি দেখলে বানর সংকেত দেবে "হু আ হু", এখন কোনো বানর শিকারি দেখতে পেল, পাশাপাশি তার ক্ষুধাও পেয়েছে। এমন সময় বানরটি একসাথে দুটো সংকেত ব্যবহার করতে পারবেনা। তাকে যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে।
কিছু বিজ্ঞানী এই বনের বানরকে ধরে এনে ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে সভ্য বানানোর চেষ্টা চালিয়েছে। এবং তার মাঝে একটি জনপ্রিয় পরীক্ষা হল তাদের ভাষা শেখানো। আর যেহেতু আজকে লেখার টপিক এটাই তাই এই পরীক্ষার দিকেই দৃষ্টিপাত করতে হয়। গবেষকরা এই বনের বানরদের উপর পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, তাদের দিয়ে কথা বলানো না গেলেও, ভাষা শেখানো সম্ভব। কোন ভাষা? মূকদের ভাষা। সাইন ল্যাংগুয়েজ।
প্রথম সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখে সভ্য বনে যাওয়া বানরটির নাম হল ওয়াসুইই। ইউনিভার্সিটি অব নেদাভার বিজ্ঞানী আর এলেন ও ব্যাটেরিং গার্ডেনার তাকে ১৯৬৬ সালে ১ বছর বয়সী অবস্থায় নিয়ে আসেন। ৪ বছর বয়সে প্রাইমেট স্টাডিজের লক্ষ্যে তাকে ওকলাহোমায় পাঠানো হয়। প্রথমে তাকে এমন খাচা দেয়া হয় যেখান থেকে সে কোনো মানুষের মুখের ভাষা শুনতে পারবেনা। এরপর থেকে গবেষকরা তার সাথে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা শুরু করে। এবং ধীরে ধীরে সে প্রায় একশোটার মতো সাইন রপ্ত করে ফেলে। দু বছর বয়সের মাঝেই ওয়াশুইই কিছু সাইন একত্র করে বাক্য বানানো শুরু করে। যেমন- তুমি আমি দ্রুত বাইরে যাব। ওয়াসুইই এর পর সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখানো হয় 'লুসি' নামের এক শিম্পাঞ্জিকে।
রজার ফাউজ লুসিকে সপ্তাহে দুদিন করে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাতেন। ভাষা রপ্ত করার পরে লুসি আর ওয়াসুইইকে আলাদা করে দেয়া হতো পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে তারা কথা বলতো এবং ভাষা শেখানোর পর তারা মানুষের মতোন আচরণ করা শুরু করেছিল। তারা মিথ্যা বলত, কখনো কখনো কসম করত এবং ঠাট্টাও করতো। তাছাড়া কখনো কখনো তারা বিভিন্নভাবে বিরক্তিও প্রকাশ করত। এবং অন্যান্য শিম্পাঞ্জিদেরকে গালি পর্যন্ত দিতো। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা তারা শুরু করেছিল তা হচ্ছে অন্য শিম্পাঞ্জিদেরকে ভাষা শেখানো। তারা নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা ছুঁড়ে দিতে চাইত।
ওয়াসুইই তার নিজ সন্তানসহ আরও অনেক শিম্পাঞ্জিকে ভাষা শেখানোর চেষ্টা করে। এবং সে সফলও হয়। সাধারণত এরকম পরীক্ষাগুলো শিম্পাঞ্জিদের দিয়েই করানো হতো, গরিলা আকারে খুব বৃহৎ হওয়ায় গবেষকরা যেন এদের নিয়ে কাজ করার খুব একটা সাহস দেখাতে চাইতেন না। কিন্তু সাইকোলজিস্ট প্যালি প্যাটার্সন একটা গরিলার উপড় পরীক্ষা চালানোর সাহস করেন। এই গরিলার নাম তিনি দেন 'কো কো'। কোকো প্রায় চারশো সাইন রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং প্রায় সাতশ রকমে তা ব্যবহার করতে জানতো। তাছাড়া সে ভাষা ব্যবহারে দারুন সৃজনশীলতা দেখিয়েছিল। সে নিজের মতোন করে শব্দ বানিয়ে নিতে পারতো। প্রথমবার হাস দেখে সে হাসের নাম দিয়েছিল ওয়াটার বার্ড। এসব পরীক্ষা প্রমাণ করে যে ভাষা রপ্ত করার দক্ষতা বনমানুষের মাঝে আছে। কিন্তু তবুও কেন তারা কথা বলতে পারেনা?
কারণ হলো একটা বিশেষ টাইপের জিন। নাম তার FOXP2. এই মিউটেটেড জিন মানুষকে ভাষা রপ্ত করার সুপার পাওয়ার দিয়েছে। যা অন্যকোনো প্রানীর নেই। বনমানুষেরও নেই। বনমানুষ ও মানুষের জিনম তুলনা করে জানা গেছে প্রায় দের লাখ বছর আগে মানুষের মাঝে এই জিনের মিউটেশন শুরু হয়েছিল। সেই জিনই ভাষার দিক থেকে ফারাক এনে দিয়েছে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের। ভাষা থাকলে আজ হয়তো তাদেরও বিজ্ঞান থাকতো, সভ্যতা থাকতো।
FOXP2 জিনের অভাবে বনমানুষরা কথা বলতে পারবেনা। যদিও সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে যোগাযোগ সম্ভব। তাছাড়া সে ভিকির মতোন মাম্মা, পাপ্পা, আপ, কাপের মতোন গুটি কতক শব্দ তাদের দিয়ে আওড়ানো সম্ভব। হয়তো বিজ্ঞান কোনোদিন আরও উন্নত হবে। হয়তো কোনো দিন কোনো বনমানুষের মুখে ভাষা আনতে পারবে আমাদের বিজ্ঞানীরা। ততোদিন এই ফারাক থাকুক। এক রিপোর্টার সাইন ল্যাংগুয়েজে কোকোকে জিজ্ঞেস করেছিল, "হোয়াট আর ইউ? এনিমেল অর এ পার্সন?" কোকো উত্তর দিয়েছিল, "ফাইন এনিমেল, কোকো।"
কোকোর এই লাইনটাই আসলে আজকে আমার এই লেখার মূল ভাব!