এন্ড্রু কিশোর বলতেন, "শিল্পী অনেক বড় ব্যাপার। আমি কষ্ট করে গান গাই। চেষ্টা করি। আমি হচ্ছি শ্রমিক। কণ্ঠশ্রমিক! শিল্পের পর্যায়ে যেতে অনেক সাধনা করতে হবে!" এমন নিখাদ বিনয় আজকাল কারো মধ্যে চোখে পড়ে?

ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, এক মাস থেকে এক বছর, আয়ুষ্কাল হতে পারে যে কোন কিছুই। এন্ড্রু কিশোর নামের মানুষটার মন খারাপ হয়েছিল, নিজের মৃত্যুর সময়সীমা আগাম জেনে গেলে যে কারোরই মন খারাপ হবে। তবু তিনি শান্ত থেকেছিলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করে বলেছিলেন, "আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আমি দেশের মাটিতে মরতে চাই। এখানে মরে গেলে আমাকে পাঠাতে গিয়ে তোমরাই ঝামেলায় পড়বে।" এন্ড্রু কিশোরের শেষ ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে, নিজের দেশে, নিজের পরিবারের মানুষগুলোর সামনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সবাইকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা করেছেন অন্য এক ভূবনের পানে- এটাকে সৌভাগ্যও বলতে পারেন চাইলে। সবাই তো এতটা প্রিভিলেজও পায় না ভাগ্যের কাছে। 

নন হজকিন লিম্ফোমা- ছোট্ট তিনটে শব্দ, আরও ছোট করে বললে ব্লাড ক্যান্সারের একটা ধরন- এটাই এন্ড্রু কিশোরের জীবনপ্রদীপটা নিভিয়ে দিলো। মাস চারেক আগেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজন অসুস্থ শিল্পীকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন, গেয়েছিলেন তার বিখ্যাত গানটা- "জীবনের গল্প, আছে বাকী অল্প... যা কিছু দেখার নাও দেখে নাও, যা কিছু বলার যাও বলে যাও; পাবে না সময় আর হয়তো..." এন্ড্রু কিশোরের জীবনের গল্পটা থেমে গেল গতকাল। যা কিছু দেখতে চেয়েছিলেন, যা বলতে চেয়েছিলেন, যা শোনাতে চেয়েছিলেন- সব কি শেষ করে যেতে পেরেছিলেন তিনি? 

তাকে ডাকা হতো 'প্লে-ব্যাক কিং' নামে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার নামটা সোনার হরফে লেখা থাকবে আজীবন। এত এত জনপ্রিয় গান তিনি গেয়েছেন, সেগুলোর তালিকা দেয়া শুরু হলে বরং পাঠকই বিরক্ত হয়ে যাবেন, এত দীর্ঘ সেই তালিকা। সিনেমার গানে তিনি এত বেশি সময় দিয়েছেন যে, সলো অ্যালবামের দিকে সেভাবে নজরই দিতে পারেননি কখনও। 

জনপ্রিয় শিল্পীরা একটার পর একটা সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হন, এন্ড্রু কিশোর চুক্তি করতেন গণ্ডায় গণ্ডায়। কারণ পরিচালকদের ডিমান্ড, একটা সিনেমায় নায়কের লিপে পাঁচটা গান থাকলে তিন-চারটাই গাওয়ানো হতো এন্ড্রু কিশোরকে দিয়ে। জাফর ইকবাল বা সালমান শাহ থেকে শুরু করে রিয়াজ, শাকিব খান- সবার লিপে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। এবং চমৎকারভাবে সেগুলো মানিয়েও গেছে সব নায়কের সঙ্গে। 

এন্ড্রু কিশোর

ভারতে শিল্পীদের জনপ্রিয়তার একটা প্যাটার্ন আছে, খেয়াল করলে দেখবেন। সেটা মোহাম্মদ রফি বা কিশোর কুমার থেকে শুরু করে কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, সনু নিগম বা আজকের অরিজিত সিং- এদের সবাই যখন পিক পয়েন্টে ছিলেন, কয়েক বছর ধরে রাজত্ব করে গেছেন একটানা। কারো ক্ষেত্রে সেই সময়সীমাটা একযুগ, বা তারও বেশি ছিল, কারো ক্ষেত্রে পাঁচ-সাত বছর। গত কয়েক বছর ধরে অরিজিতের মৌসুম চলছে, আরও কয়েক বছর যে যাবে সন্দেহ নেই, তারপর হয়তো নতুন কেউ আসবে। 

বাংলাদেশে এই কালচারটা ছিল না। অন্তত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তো না। এন্ড্রু কিশোর এখানে একচেটিয়া রাজত্ব করেছেন, দুই-চার-দশ বছর নয়, টানা তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে সিনেমার গানে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। অন্য শিল্পীরাও গান গেয়েছেন সমানতালে, কিন্ত গানের সংখ্যায় আর মানে এন্ড্রু কিশোর বাকীদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। 

তার জনপ্রিয় গানের তালিকা করতে গেলে মাথায় হাত দিয়ে বসবে যে কেউ, এত এত গান তিনি গেয়েছেন, সেসবের বেশিরভাগই তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে, কাল্ট ক্ল্যাসিকে পরিণত হয়েছে অনেকগুলো- অসাধারণ মেধার অধিকারী না হলে এই ধারাবাহিকতা কোথাও ধরে রাখা সম্ভব নয়। এন্ড্রু কিশোর সেটা করে দেখিয়েছেন। প্লে-ব্যাক কিং খেতাবটা তো এমনি এমনি জুড়ে যায়নি নামের পাশে। 

এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের একজন ছিলেন তিনি, অথচ স্বভাবে ছিলেন মাটির মানুষ। তার কথাবার্তায়, আচরণে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়তো, সেটা হচ্ছে বিনয়। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ আইডল নামের একটা প্রতিযোগীতার বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেটারই একটা পর্বে বলেছিলেন, ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে গান গাইলেও, এখনও নিজেকে কণ্ঠশিল্পী ভাবেন না তিনি, নিজেকে মনে করেন কণ্ঠ শ্রমিক হিসেবে। বলেছিলেন, "শিল্পী অনেক বড় ব্যাপার। আমি কষ্ট করে গান গাই। চেষ্টা করি। আমি হচ্ছি শ্রমিক। কণ্ঠশ্রমিক! শিল্পের পর্যায়ে যেতে অনেক সাধনা করতে হবে!" এমন নিখাদ বিনয় আজকাল কারো মধ্যে চোখে পড়ে? 

এইতো, গত ফেব্রুয়ারী মাসের কথা। এন্ড্রু কিশোর তখন চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন সিঙ্গাপুরে, কেমো নিতে হচ্ছে, শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। একটা ফান্ড রাইজিং ইভেন্টে তবুও হুইলচেয়ারে বসে হাজির হয়েছিলেন তিনি, মঞ্চে উঠে গেয়েছিলেন তার বিখ্যাত গান- জীবনের গল্প, আছে বাকী অল্প'। গান শেষে সেখানে থাকা সাবিনা ইয়াসমিন এবং সৈয়দ আবদুল হাদীর হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন একটা খাম, সেটার ভেতরে ছিল পাঁচ হাজার সিঙ্গাপুরিয়ান ডলারের একটা চেক। বড় অংকের এই টাকাটা এন্ড্রু কিশোর দিয়েছিলেন সুরকার সেলিম আশরাফের চিকিৎসার জন্যে! 

এন্ড্রু কিশোর, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায়

সেলিম আশরাফকে যারা চেনেন না, তাদের জন্য জানিয়ে রাখি,  ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা’ সহ আরও অনেক জনপ্রিয় দেশাত্ববোধক গানের সুর করেছিলেন এই গুণী সুরকার। একটা মানুষ নিজে লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে, অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি নিজের নামে আয়োজিত কনসার্টে এসেছেন, গান গেয়েছেন, আবার এক সহযোদ্ধার জন্যে সাধ্যমতো সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন! এমন নজির খুঁজে পাওয়া দুস্কর।

বিখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক আরডি বর্মনের সুরে গান করেছিলেন তিনি, তাও মুম্বাইতে গিয়ে! আরডি বর্মন তাকে খুবই পছন্দ করেছিলেন, তিনি এন্ড্রু কিশোরকে ডাকতেন 'ঢাকাইয়া' নামে। আরডি বর্মন বলতেন, 'ঢাকাইয়া, তুই এখানেই থেকে যা, দেশে যাওয়ার দরকার নেই। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।' এন্ড্রু কিশোর রাজী হননি, বলেছিলেন, 'দাদা, আমার দেশেই আমি অনেক ভালো আছি।' আরডি বর্মন তখন তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই একটা বাঘের বাচ্চা!’

হানিফ সংকেতের ইত্যাদির মাধ্যমে প্রথমবার কোন টিভি ম্যাগাজিনে হাজির হয়েছিলেন, গানের নাম ছিল 'পদ্মপাতার পানি নয়'। এরপরে নিয়মিতই ইত্যাদিতে দেখা গেছে তাকে, হানিফ সংকেত তার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। সিঙ্গাপুরের ডাক্তার যখন জানিয়ে দিলেন, আর কোন আশা নেই, তখন দেশে ফিরে এন্ড্রু কিশোর প্রথম ফোনটা হানিফ সংকেতকেই দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘দোস্ত আমার জার্নি শেষ, আই অ্যাম রেডি টু ফ্লাই। আমার অবস্থা ভালো না। আসার দরকার নাই, তাতে কষ্ট কম পাবি।’ 

'ডাক দিয়াছেন, দয়াল আমারে...'- এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন অনেক বছর আগে। দয়ালের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে, জীবনের গল্পটা শেষ হয়েছে এন্ড্রু কিশোরের, মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে তিনি পরিপূর্ণ সুখী হবেন, সুরেলা গলায় মাতিয়ে রাখবেন স্বর্গের অন্দরমহল, এটাই প্রার্থনা করি...

আরও পড়ুন- 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা