প্রিয় এন্ড্রু কিশোর, জীবনের গল্প তো এখনও অনেকটাই বাকি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একটা মানুষ নিজে লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে, অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি তার নামে আয়োজিত কনসার্টে এসেছেন, গান গেয়েছেন, আবার এক সহযোদ্ধার জন্যে সাধ্যমতো সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন! এই 'লার্জার দ্যন লাইফ' চরিত্রের মানুষটার নাম এন্ড্রু কিশোর, ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই যাকে 'প্লেব্যাক কিং' হিসেবে চেনে...
যে জায়গাটায় এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, সেটা ভীষণ সংকটাপন্ন। ফিরে আসার লড়াইটা তিনি চালাচ্ছেন জোর কদমে, তার সঙ্গে আছে এই দেশের কোটি মানুষের দোয়া আর ভালোবাসা। মরণ ব্যাধির সঙ্গে লড়াইয়ের ছাপটা তার মধ্যে স্পষ্ট, মাথার চুলগুলো পড়ে গেছে, শরীরটাও ভেঙ্গে পড়েছে ভীষণ। সেই দুর্বল শরীর নিয়েই হুইলচেয়ারে বসে এন্ড্রু কিশোর নামের মানুষটা মাইক্রোফোন হাতে নিলেন, গেয়ে উঠলেন- ‘জীবনের গল্প, আছে বাকী অল্প…’
ব্লাড ক্যান্সার এন্ড্রু কিশোরকে দুর্বল করে দিয়েছে, কিন্ত তার কণ্ঠের মাদকতায় বিন্দুমাত্র আঘাত হানতে পারেনি। আগের মতোই জোরালো গলায়, মায়াভরা কণ্ঠে তিনি গান শোনালেন, সেই গান শুনে পেছনে দাঁড়ানো সাবিনা ইয়াসমিন কাঁদলেন, সৈয়দ আবদুল হাদী বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন মঞ্চের ওপরে, অশ্রু টলোমল চোখ তখন দর্শকসারিতে থাকা শত শত শ্রোতার, এন্ড্রু কিশোর নামটার জন্যেই যারা বিদেশ বিভূঁইয়ে হাজারটা কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন!
নন হজকিন লিম্ফোমা নামের এক ধরণের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে এন্ড্রু কিশোরের শরীরে, সিঙ্গাপুরে চলছে চিকিৎসা, দেয়া হচ্ছে কেমো এবং রেডিওথেরাপি। গত কয়েক মাস ধরেই সেখানে অবস্থান করছেন এন্ড্রু কিশোর এবং তার পরিবার। বাংলাদেশ সরকার তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, গুণী এই শিল্পীর চিকিৎসার সব খরচ বহন করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। মৃত্যুদূতের সঙ্গে এই অসম লড়াইয়ে এন্ড্রু কিশোর জিতবেন কিনা, সেটা আমরা জানিনা। কিন্ত এটুকু জানি, পুর দেশের মানুষ আর তাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে আছে।
বেতারে গান গেয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল এন্ড্রু কিশোরের শিল্পী জীবনের। ১৯৭৭ সালে অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে তার আগমন, অনেকটা ধুমকেতুর মতোই। খুরশীদ আলম, আবদুল হাদীরা তখন চুটিয়ে গাইছেন। এরইমধ্যে মেইল ট্রেন নামের একটা সিনেমায় প্রথম গানে কণ্ঠ দিলেন তিনি। এরপর গাইলেন এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী সিনেমাতেও। এরপরের গল্পটা তো ইতিহাস।
বাংলা সিনেমার গানকে একটা অন্যরকম মাত্রায় নিয়ে গেছেন এন্ড্রু কিশোর একাই। তার কণ্ঠ দেয়া গানের সংখ্যা হিসেব করতে বসলে বোধহয় গিনেজ বুকে রেকর্ড হয়ে যাবে একটা। জীবনের গল্প আছে বাকী অল্প, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, সবাই তো ভালোবাসা চায়- তার গাওয়া জনপ্রিয় গানের তালিকা করতে বসলে এই লেখাটাই আর শেষ হবে না। ইন্ডাস্ট্রিতে তো এন্ড্রু কিশোরকে ডাকাই হয় প্লেব্যাক কিং নামে!
শিল্পী হিসেবে তিনি অসাধারণ, আর মানুষ হিসেবে? ছোট্ট একটা নমুনা দেয়া যাক। সিঙ্গাপুরে যে অনুষ্ঠানের মঞ্চে এন্ড্রু কিশোর গাইলেন একদিন আগে, সেটার আয়োজন করা হয়েছিল তার চিকিৎসার জন্যে ফান্ড রেইজ করার উদ্দেশ্যে। এর আগেই এন্ড্রু কিশোর খবর পেয়েছিলেন, বিখ্যাত সুরকার সেলিম আশরাফ ভীষণ অসুস্থ, অর্থকষ্টেও ভুগছেন।
সেলিম আশরাফকে যারা চেনেন না, তাদের জন্যে জানিয়ে রাখি, ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা’ সহ আরও অনেক জনপ্রিয় দেশাত্ববোধক গানের সুর করেছিলেন এই গুণী সুরকার। অনুষ্ঠানে এসে অসুস্থ শরীর নিয়েও এন্ড্রু কিশোর গান তো গেয়ে শুনিয়েছেনই, সেই সঙ্গে সাবিনা ইয়াসমিন এবং সৈয়দ আবদুল হাদীর হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন একটা খাম, সেটার ভেতরে ছিল পাঁচ হাজার সিঙ্গাপুরিয়ান ডলারের একটা চেক। বড় অংকের এই টাকাটা এন্ড্রু কিশোর দিয়েছেন সেলিম আশরাফের জন্যে!
একটা মানুষ নিজে লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে, অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি নিজের নামে আয়োজিত কনসার্টে এসেছেন, গান গেয়েছেন, আবার এক সহযোদ্ধার জন্যে সাধ্যমতো সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন! প্রিয় এই শিল্পী খুব জলদি ক্যান্সারকে হারিয়ে ফিরে আসবেন সবার মাঝে, এটাই আমাদের কামনা। কোটি মানুষ যাকে ভালোবাসে, যার জন্যে দোয়া করে, তার জীবনের অনেক গল্পই এখনও বাকী। সেই গল্পগুলো আমরা এন্ড্রু কিশোরের মুখ থেকে শুনতে চাই, তার দরাজ কণ্ঠে, গানের সুরে সুরে…