আমির খানের সিনেমা, তিনি যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন সেগুলোকে বয়কট করার ডাক দিচ্ছে বিজেপি ও কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠনের নেতারা। আমিরের গায়ে লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে দেশদ্রোহী ট্যাগ! কিন্ত কী এমন করেছেন আমির? তুরস্কের ফার্স্ট লেডির সাথে ছবি তোলাটা কি অপরাধ?

আরও একবার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আমির খান, তাকে নিয়ে ঝড় উঠেছে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে। আমিরের সিনেমা, আমির যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন সেগুলোকে বয়কট করার ডাক দিচ্ছেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে আঁতিপাঁতি কর্মী বা বিভিন্ন কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন। রঙ দে বাসন্তী বা লগনের মতো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া সিনেমায় অভিনয় করা আমিরের গায়ে লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে দেশদ্রোহী ট্যাগ! কিন্ত কী এমন করেছেন আমির? তার অপরাধটা কী? 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ।এরদোয়ানের স্ত্রী এবং দেশটির ফার্স্ট লেডি এমিনে এর্দোয়ান টুইটারে আমিরের সঙ্গে তিনটা ছবি আপলোড করেছেন। হাসিমুখে সেখানে আমিরকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে এমিনের সঙ্গে। সেই ছবিগুলো অন্তর্জালে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আমিরের ওপর আক্রমণ শাণিয়েছে বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া উইং, সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন দলটির হেভিওয়েট সব নেতাও। কট্টরপন্থী হিন্দুরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে গালিগালাজের মিছিলে। 

মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তুরস্কের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর হওয়া নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছে তুরস্ক, ভারত সরকার যখন কাশ্মীরের অধিবাসীদের অধিকার হিসেবে বিবেচিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে, তখনও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন এরদোয়ান। তাছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্ক বরাবরই ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তাই আমির খান যখন তুরস্কের ফার্স্ট লেডির সঙ্গে দেখা করেছেন, ছবি তুলেছেন, তখন বিজেপির আঁতে ঘা লেগেছে, আমিরকে নিশাণা বানিয়েছে তারা।

আমির খান এমিনে এরদোয়ান

হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ফরেস্ট গাম্পের হিন্দি রিমেক করছেন আমির খান, সেটা তো সবাই জানেন। সিনেমার নাম লাল সিং চাড্ডা, এটাও নতুন কোন তথ্য নয়। এই সিনেমার প্রায় সত্তর ভাগ শুটিং শেষ, করোনার কারণে বাকি শুটিং আটকে আছে অনেকদিন ধরেই। এর মধ্যে অনেকটুকু অংশের শুট হবে তুরস্কে, গল্পের প্রয়োজনেই তুরস্ককে বেছে নেয়া হয়েছে শুটিংয়ের জন্য। করোনার লকডাউন শুরু হবার আগে আমির একবার শুটিং স্পট দেখার জন্য তুরস্কে গিয়েছিলেন। ছবিগুলো তখনই তোলা। 

এমিনে ও আমিরের সাক্ষাৎকারের কথা জানাজানি হওয়ার পরই ভারতে তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে বিজেপি নেতা ও সমর্থকরা। বিজেপি সাংসদ সুব্রমানিয়াম স্বামী টুইট করে বলেন, ''আমির খানকে আমি থ্রি খান মাস্কেটিয়ার্স-এর অন্যতম বলেছিলাম। আমার কথা যে ঠিক তা প্রমাণ হলো।'' বিজেপির দাঙ্গাবাজ নেতা কপিল মিশ্র, যিনি দিল্লি দাঙ্গার জন্য সরাসরি দায়ী- সেই লোক টুইট করেছে- ''মাই নেম ইজ খান এবং আমি খলিফা শাসনে বিশ্বাসী: আমির খান।'' সুরেশ নাখুয়া নামে আরেম বিজেপি নেতা টুইট করেছেন- ''আমির খান কোন কোন ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন করেছেন তা কি কারো জানা আছে? থাকলে জানান।'' অর্থাৎ, আমির খানের সিনেমা, এমনকি তার বিজ্ঞাপন করা ব্র্যান্ড বয়কট করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে ভারতে! 

আমির খান একজন প্রফেশনাল অভিনেতা, তুমুল জনপ্রিয়তা তার। অন্য একটা দেশে কাজ করতে গেলে সেখানকার প্রেসিডেন্ট বা ফার্স্ট লেডির সঙ্গে তিনি দেখা করতেই পারেন। গোটা ব্যাপার‍টা নিয়ে তিলকে তাল বানানোর সবচেয়ে বড় কারণ ভারতের অভ্যন্তরীন সব ইস্যু থেকে মানুষের নজর সরানো। করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতা, চীনের হাতে মার খাওয়া, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা- সব মিলিয়ে বিজেপি সরকার নাজেহাল অবস্থায় আছে। সেসব দিকে কেউ যাতে নজর না দেয়, এজন্য বিজেপির অনলাইন সেল কখনও সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে উঠেপড়ে লাগে, কখনও আমির খানকে বয়কটের ডাক দেয়! 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি যখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা নিয়ে আচমকা ইসলামাবাদে উড়ে যান, পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সঙ্গে এক টেবিলে বসে বিরিয়ানি খান, অথবা ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর তাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানান, কিংবা কোন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে হাত মেলান- তখন সেসব ছবি নিয়ে বিজেপি বা কট্টরপন্থী হিন্দুদের কাউকে 'বয়কট মোদি' ডাক দিতে দেখা যায় না। 

আমির খান ও রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান- আগের ছবি

আমির খানকে নিয়ে অবশ্য বিজেপি বা কট্টর হিন্দুদের অ্যালার্জিটা অনেক পুরনো। পিকে সিনেমায় ধর্ম ব্যবসার স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন আমির, তখনও তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, সিনেমা নিষিদ্ধের দাবী উঠেছে। গরুর মাংস খাওয়ার গুজব ছড়িয়ে যখন মুসলমানদের পিটিয়ে মারা হচ্ছিল, কিংবা কেউ সরকারের বিরোধিতা করলেই তাকে 'দেশদ্রোহী' বানিয়ে দেয়া হচ্ছিল- তখন আমির এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশজুড়ে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। সেটাও বিজেপির গায়ে লেগেছিল, কারণ ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না! অসহিষ্ণুতার জন্য কে দায়ী, সেটা বিজেপি তো ভালোভাবেই জানে! 

পুরো ঘটনায় সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মোদি আর এরদোয়ান দুজনেই কিন্ত শাসক হিসেবে একই ঘরানার। ধর্মকে আঁকড়ে ধরে তারা নিজেদের গদি শক্ত করেছেন। দুই দেশেই সংখ্যালঘু সঅম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস আছে। এরদোয়ান যেমন নিজের দেশে হাজার বছরের পুরনো গীর্জা হায়া সোফিয়াকে মসজিদ বানিয়েছেন, তেমনই নরেন্দ্র মোদির বিজেপি বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানাচ্ছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রূপ দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে দুই দেশেই। তাহলে এর্দোয়ানকে নিয়ে বিজেপির এত আপত্তি কীসের- এটা একটা বড় প্রশ্ন।

তবে বয়কটের ডাক দেয়া হোক কিংবা দেশদ্রোহী ট্যাগ দেয়া হোক- সিনেমার ব্যবসার জন্য এটা বরং ভালোই। এর আগে শাহরুখের রইস সিনেমার আগেও বিজেপি এমন প্রোপাগাণ্ডা চালিয়েছিল। তাতে শাহরুখই লাভবান হয়েছিলেন। সঞ্জয় লীলা বানশালির পদ্মাবত সিনেমাটার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। লাল সিং চাড্ডা এখন রিলিজ হলে সেটাও যে ব্লকবাস্টার হতো- এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা