করোনায় মৃত দুইশোরও বেশি মানুষকে সৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন যে অ্যাম্বুলেন্স চালক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই আরিফ খান ছিলেন দুর্দমনীয়। আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন, মৃত মানুষদের সৎকারের ব্যবস্থাও করতেন। সেই মহৎ হৃদয়ের মানুষটির যে এমন করুণ পরিণতি হবে, তা কী কেউ ভেবেছিল?
একজন মানুষের গল্প বলবো আজ। যে মানুষটিকে হয়তো কেউই চেনেন না। চেনার কথাও না। তিনি নায়ক নন, রাজনীতিবিদ নন, শিল্পপতিও নন। তিনি একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক। তিনি অ্যাম্বুলেন্স চালান। ভুল বললাম, চালাতেন। তিনি এখন অতীত কালের এক চরিত্র, যিনি প্রয়াত হয়েছেন সম্প্রতি। আজ তাঁর গল্পই জানবো আমরা।
মানুষটির নাম আরিফ খান। দিল্লীর শহিদ ভগৎ সিং সেবা দলের অ্যাম্বুলেন্স বেশ অনেকদিন ধরেই চালালেও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি হয়ে উঠছিলেন দুর্দমনীয়। করোনার এই বিক্ষুব্ধ সময়ে করোনা-আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে করোনায় মৃত মানুষকে সৎকারের জন্যে যথাযথ স্থানে পৌঁছে দেয়া... সবই করতেন আটচল্লিশ বছরের আরিফ। যেখানে অনেক অ্যাম্বুলেন্স চালক ভয়ে করোনা-রোগীদের এড়িয়ে চলতেন, সেখানেই আরিফ ছিলেন সবার থেকে আলাদা। এমনও হয়েছে, করোনায় মৃত রোগীকে নেয়ার মত কেউ নেই। ভয়ে পরিবারের কেউও আসেনি, লাশ নেয়ার জন্যে। আরিফ তখন নিজের পকেটের পয়সা থেকে শেষকৃত্যের খরচ দিয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার সে, কতই বা আর বেতন? মাসে পেতেন মাত্র ১৬০০০ টাকা। সেই টাকার মধ্যে ৯০০০ টাকা যেতো বাড়িভাড়াতেই। বাকি টাকায় কায়ক্লেশে জীবনযাপন। সেখানেও তিনি ভাগ্যহীন মৃতদের শেষকৃত্যের জন্যে নিজের পকেটের গুটিকয়েক সম্বল নিঃশেষে উজার করতেন।
আরিফ খান এরকমই ছিলেন। অসংখ্য করোনা-পজেটিভ রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর পাশাপাশি দুইশোরও বেশি করোনায় মৃত রোগীকে সৎকারের জন্যেও নিয়ে গিয়েছে তাঁর অ্যাম্বুলেন্স। এই কাজে ঝুঁকি ছিলো। নিজে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি। নিজের পরিবার সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি। তাও আরিফ থামেন নি। গত ছয় মাস ধরেই এ কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বাড়িতে গেলে বাড়ির মানুষ সংক্রমিত হতে পারে, তাই বাড়িতেও যেতেন না। থাকতেন অ্যাম্বুলেন্সেই। পরিবারের মানুষ তার মুখটাও দেখেনি, গত ছয় মাসে।
আশা ছিলো, পৃথিবী আবার শান্ত হলে দেখা হবে পরিবারের সাথে। কিন্তু তা আর হয়নি৷ কয়েকদিন আগেই করোনা-আক্রান্ত হয়েই মারা গিয়েছেন আরিফ খান। পরিবারের সাথেও শেষ দেখা না হওয়ার আক্ষেপ নিয়েই চলে যেতে হয়েছে তাকে। চিরদিনের জন্যে।
স্রষ্টার হিসেব-নিকেশ মাঝেমধ্যে অদ্ভুত মনে হয় আমার। এই মানুষটির এভাবে চলে যাওয়ার কথা ছিলো না মোটেও। গত ছয় মাস ধরে যে মানবিক কাজ তিনি করেছেন, সেখানে এরকম বিদায় কাম্যও নয় তাঁর। কিন্তু বিধাতার স্ক্রিপ্ট বলে কথা! সে স্ক্রিপ্টে হাত লাগাবে সাধ্য কার! তবে আরিফ খানের মৃত্যু বুঝিয়ে দিয়েছে এক নির্মোহ সত্য, তাঁর মত মানুষগুলো ছিলেন বলেই মহামারীর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে এখনও টিকে আছে মানুষ। যদিও আরিফ খানদের কেউ মনে রাখেনা কোনোদিন। তবুও এই যে আমরা দুয়েকজন জানলাম তাকে নিয়ে, অলক্ষ্যে চোখের জল ফেললাম, আরিফ খান হয়তো তাতেই খুশি। হয়তো এটাই ভবিতব্য।
ওপারে ভালো থাকবেন আপনি। বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন