তিনি বাংলা সিনেমা করেছেন, তিনি বাংলা কবিতা পড়তেন, তিনি বাংলাকে এমনভাবে বলতেন, শুনে মনে হতো চমৎকার কোনো রান্নার ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁকে ভালোবাসার এরচেয়ে বেশি আর কী কারণ লাগে?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এমন একজন মানুষ যিনি এমনি কথা বললেও মনে হতো কবিতা আবৃত্তি করছেন৷ এত দরদ দিয়ে কথা বলার মতো আরো অভিনেতা থাকতেও পারেন, তবে আমি অন্তত দেখিনি।

বাংলা আর্ট ফিল্মের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ভীষণ জনপ্রিয় মুভি "প্রাক্তন" এর পরিচালক শিবপ্রসাদ এ ব্যাপারে খুব চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন। সম্ভবত মীরাক্কেলে গেস্ট হিসেবে এসে বলেছিলেন, "আমি চাই প্রাক্তন মানুষ দেখুক। কেউ যদি মুভির গল্প বা অভিনয় নাও দেখতে চায় তাও আসুক সৌমিত্রের জন্য। আমি যদি এই মুভির পরিচালক না হতাম তারপরও এই সিমেনা দেখতাম অন্তত একটা কারণে। ট্রেনে সৌমিত্র একটা কবিতা আবৃতি করেছেন, এই কবিতা শোনার জন্য আমি হলে যেতাম।"

যৌবনের সৌমিত্রকে পুরোপুরি দেখা হয়নি। সব মুভি দেখা হয়নি এখনো। এই সময়ে এসে সেই সময়ের মুভি দেখে শতভাগ রিলেট করাও অবশ্য একটু কঠিন৷ তবে শেষ বয়সের সৌমিত্রকে মিস করিনি। কোনো নতুন মুভি আসলে আর সেখানে সৌমিত্রের নাম কাস্ট হিসেবে থাকলে মুভির রেটিং খুঁজতে যাইনি। যেখানে সৌমিত্র আছেন সেই মুভি যেমনই হোক, সেখানে কিছু একটা তো অবশ্যই আছে।

বয়স আশি পেরিয়ে যাবার পর শরীরে আর সেই জোর আশা করা যায় না। ধীর হয়ে গিয়েছে চলাফেরা, মুভমেন্টও অনেকটাই স্লথ। ডায়লগ ডেলিভারি দিতেন প্রায় একই ধাঁচে, ধীরে। 

কিন্তু তবুও স্ক্রিনে এক পলকের জন্যেও তাঁকে বিরক্তিকর লাগে না। বিরক্তিকর শব্দটা উচ্চারণ করা ধৃষ্টতা হয়ে যায়, বলা যায় এক সেকেন্ডও মনে হতো না তিনি স্ক্রিনে অবাঞ্চিত। তার চাহনী, চোখের পলক, হাসি, ভাজ পড়া গাল বা চশমা খোলার প্রতিটা দৃশ্যকেই মনে হতো অবশ্যম্ভাবী।

বেশিরভাগ দৃশ্যেই বসে থাকতেন, শুয়ে থাকতেন, দাঁড়িয়ে থাকতেন নয়তো হাঁটতেন ধীরে ধীরে। তাই দিয়েই সিনেমার বাকি সব এক্টিভ চরিত্রকে ভীষণ ম্লান লাগত৷

মনে পড়ছে "পোস্ত" ছবিতে পুত্র যিশুকে বলা ছোট্ট একটা বাক্য- "তোমার সঙ্গে আমার কোর্টে দেখা হবে"। এই এক লাইন এতটা ভারী ছিল, এতটা গভীর ছিল, এতটা ধাক্কা লেগেছিল... এই ডায়লগ অন্য কেউ দিলে ভগ্নাংশ পরিমাণ ইমপ্যাক্ট পড়ত কিনা কে জানে!

নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন তিনি। তরুণ বয়সের অনেক জনপ্রিয় অভিনেতা মধ্য গগণ পার করার আগেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন। অনেকে শেষ বয়সে এসে পান ট্র‍্যাক৷ বাংলা সিনেমায় একদিনের জন্যেও সৌমিত্রের আবেদন নষ্ট হয়নি।

দুই হাজার বিশ সাল তারকা পতনের বছর৷ একের পর এক তারকার বিদায় দেখতে হচ্ছে আমাদের। সবার জন্যই দুঃখ লেগেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধাক্কাও লেগেছে।

তবে ব্যক্তিগতভাবে সৌমিত্রের মৃত্যুতেই বোধহয় আমি সবচেয়ে বেশি শোকাহত। উনি বাংলা সিনেমা করেছেন, উনি বাংলা কবিতা পড়তেন, তিনি বাংলাকে এমনভাবে বলতেন, শুনে মনে হতো চমৎকার কোনো রান্নার ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁকে ভালোবাসার এরচেয়ে বেশি আর কী কারণ লাগে?

সৌমিত্র বাংলা সিনেমাকে অনেক দিয়েছেন। হয়তো আরো দেয়ার ছিল। যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার জন্য অবশ্যই ব্যথিত। কিন্তু যা দিয়ে গেছেন তাতে কৃতজ্ঞ না হয়ে উপায় নেই।

করোনা নেগেটিভ হবার পর নাকি বাসায় চলে গিয়েছিলেন৷ শুনে ভীষণ স্বস্তি পেয়েছিলাম। আজকে আচমকা দেখি, তিনি নেই!

২০২০ সাল এখনো বাকি আছে এটাই মনে করিয়ে দিল। বিদায় সৌমিত্র। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা