সবাই প্রশ্ন করতেন, আপনার এত অর্জন, এত খ্যাতি, ব্যবসা আছে, তবু কেন এই বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে অভিনয় করতে আসেন? একটু তো বিশ্রাম দিতে পারেন শরীরটাকে? আলী যাকের হাসতেন, বলতেন- ‘ব্যবসা তো পেটের খিদে মেটায়, বুকের খিদে মেটাতে হবে না?’

মিলেমিয়াম জেনারেশনের সঙ্গে আলী যাকেরের পরিচয়টা ফেসবুকে কয়েক মিনিটের ভিডিও ক্লিপের সূত্র ধরে। নাটকের নাম আজ রবিবার, সেখানে তিনি পরিবারের বড় চাচা। অদ্ভুত একজন মানুষ, আপন খেয়ালে চলেন, নিজের মতো থাকতে ভালোবাসেন, নিজের মতো করে ভাবতে পছন্দ করেন। তাকে যারা বিরক্ত করতে আসে, তাদেরকে অদ্ভুত উপায়ে শায়েস্তা করেন। কিন্ত টেলিভিশনের বাইরে আলী যাকেরকে যারা মঞ্চে দেখেছে, যারা তাকে দেখেছে নূরালদীন, গ্যালিলিও কিংবা দেওয়ান গাজী চরিত্রে অভিনয় করতে, কিংবা বহুব্রীহি নাটকে তার করা 'মামা' চরিত্রটির কথা যাদের মনে আছে, তারাই জানেন, আজ ভোরে বাংলাদেশ কি হারিয়েছে। বাংলাদেশ হারিয়েছে এই মাটিতে জন্ম নেয়া সর্বকালের সবচেয়ে প্রতিভাবান অভিনেতাদের একজনকে। য্ব মানুষটার কাছে অভিনয় ছিল ধ্যান-জ্ঞান, ছিল ইবাদত। 

সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম- এমনটা বললে খুব একটা ভুল হবে না। বাবা ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ছোটবেলাটা দেশের নানা প্রান্তে কাটিয়েছেন যাকের। প্রথমে ফেনী, তারপর খুলনা, সেখান থেকে কুষ্টিয়া হয়ে ঢাকায়। খুলনায় যখন ছিলেন, তখন মা আর বোনের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতেন, যদিও সেটা তাকে খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেনি তখনও। ছোটবেলায় বড় ভাইয়ের খুব ন্যাওটা ছিলেন, বলা চলে, ভাইয়ের কাছেই মানুষ হয়েছেন আলী যাকের। বাবার পদোন্নতির কারনে ঢাকায় চলে এলো তার পরিবার, গেন্ডারিয়ায় বাড়ি বানানো হলো, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকের কথা সেটা। 

একষট্টিতে বাবা মারা গেলেন, সেন্ট গ্রেগরি থেকে মেট্রিক পাশ করে যাকের তখন ভর্তি হয়েছেন নটরডেম কলেজে। জমানো টাকাপয়সা যা ছিল, বাড়ি বানাতেই খরচ হয়ে গেছে সব। সংসারে অভাব, বাড়ির নিচতলাটা ভাড়া দিয়ে দোতলায় উঠে যেতে হলো তাদের। বিপদের তখন কেবল শুরু, চৌষট্টিতে মারা গেলেন মা, পরের বছর বড় বোন। টিকে রইলেন কেবল দুই ভাই। আলী যাকের তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, বিষয়ের নাম সোশিওলজি। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন, ছাত্র ইউনিয়ন করতেন তিনি। 

তখন পর্যন্ত নাটকের ‘ন’ও জানেন না তিনি। নাটক দেখার অভিজ্ঞতা বলতে মায়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়ে দেখা উৎপল দত্ত এবং শম্ভু মিত্রের কয়েকটা নাটক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা মিলে একটা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা করেছিল। সেখানে যে কটি বিভাগে অংশ নিয়েছিলেন আলী যাকের, তার সব কটিতেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। অভিনয়টাকে পেশা হিসেবে নেবেন, এরকম চিন্তা কখনও মাথায় আসেনি। অভিনয় যে তার কাছে নেশার মতো একটা ব্যাপার হয়ে যাবে একসময়, ৭৫ বছর বয়সে ক্যান্সার আক্রান্ত শরীর নিয়েও তিনি মঞ্চে ছুটে যাবেন- এরকমটাও ভাবেননি তখন। একটা চাকরি দরকার ছিল, হন্যে হয়ে সেটাই খুঁজছিলেন। 

আলী যাকের

একটা ব্রিটিশ কোম্পানীতে চাকরি পেয়ে করাচী চলে গেলেন। পরের কয়েকটা বছর বোহেমিয়ান হয়ে কাটিয়েছেন। এক বছর করাচী তো পরের বছর ঢাকায়, এরপর আবার করাচী, আবার ঢাকা- জীবন চলছিল এভাবে। এরমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, দেশের ক্রান্তিলগ্নে বসে থাকতে পারলেন না তিনি, যোগ দিলেন যুদ্ধে। আট নম্বর সেক্টরে মেজর মঞ্জুরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন তিনি, সাংবাদিক ও পরিচালক আলমগীর কবির তাকে যুক্ত করলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। বেতারের ইংরেজী সার্ভিসে কাজ করেছেন আলী যাকের, প্রচারণা চালিয়েছেন, হয়েছেন শব্দযোদ্ধা।

দেশ স্বাধীন হলো, তিনি ফিরে এলেন ঢাকায়। এশিয়াটিকের দায়িত্ব নিলেন, যে প্রতিষ্ঠানে তিনি আগে চাকরি করতেন। মামুনুর রশীদের সঙ্গে পরিচয় ছিল আগে থেকেই, যুদ্ধের সময় কলকাতায় দেখা সাক্ষাৎও হতো। 'দেশে গিয়ে কি করবি?' - জিজ্ঞেস করেছিলেন মামুনুর রশীদ। কিছু না ভেবেই অকপটে জবাব দিয়েছিলেন আলী যাকের- নাটক করমু। দেশ স্বাধীনের পরে একদিন হুট করেই যাকেরের অফিসে এসে হাজির হলেন মামুনুর রশীদ, বললেন, 'তুই না কইছিলি নাটক করবি? ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক করুম। আয় তুই!' আরণ্যকের ওই নাটক দিয়েই মঞ্চে অভিষেক হলো আলী যাকেরের, জন্ম হলো অসাধারণ এক অভিনেতার, পরের কয়েকটা যুগে যিনি দর্শককে মুগ্ধ করবেন তার প্রতিভার দ্যুতিতে। 

মঞ্চে যারা আলী যাকেরকে দেখেছেন, তারা এক কথায় স্বীকার করে নেন, তার অভিনয় দেখাটা চোখের শান্তি, মনের তৃপ্তি। আরণ্যক ছেড়ে নাগরিকে গিয়েছিলেন, সেটাকেই পরে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন। মঞ্চ নাটকে তিনি একটা বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিলেন, দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের আয়োজন করে। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে যেটা অবাস্তব একটা ব্যাপার ছিল। অনেকেই ভেবেছিল টাকা খরচ করে কেউ নাটক দেখতে আসবে না। কিন্ত 'বাকী ইতিহাস' নামের নাটকটা দ্বিতীয় শো থেকেই হাউজফুল যেতে শুরু করে। বাকী ইতিহাস সত্যিই ইতিহাস গড়ে ফেলেছিল, সেই ইতিহাসটা লেখা হয়েছিল আলী যাকেরের হাত ধরে। 

টেলিভিশন নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন বেছে বেছে, যে চরিত্রেই দেখা দিয়েছেন, বাজীমাত করেছেন। বহুব্রীহি নাটকে তিনি ছিলেন পাগলাটে মামার চরিত্রে, যিনি সিনেমা বানাতে চান, তোতাপাখির মুখ দিয়ে তুই রাজাকার শ্লোগান বলাতে চান। এমন চরিত্রকে ভালো না বেসে পারা যায়? কিংবা আজ রবিবারের বড় চাচা- যে চরিত্রটা কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতি পেয়েছে এখন। মতিকে দেয়া তার একেকটা থাপ্পড়, মতির চোখে লেগে থাকা কালির দাগ দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছে দর্শক। তানভীর মোকাম্মেলের 'মধুমতি' সিনেমায় তিনি হয়েছিলেন মোতালেব মোল্লা, কি দুর্দান্ত সেই অভিনয়! লালসালু আর রাবেয়া নামের দুটো সিনেমাতেও দেখা গেছে তাকে। 

মঞ্চনাটকে আলী যাকের

তবে আলী যাকেরের সেরাটা খুঁজতে গেলে আপনাকে যেতে হবে মঞ্চে। তিনি আপাদমস্তক থিয়েটার অ্যাক্টর ছিলেন। সৎ মানুষের খোঁজে, কোপেনিকের ক্যাপটেন, গ্যালিলিও, নূরলদিনের সারা জীবন, অচলায়তন, রক্তকরবী, দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা'র মতো নাটকে অভিনয় করেছেন আলী যাকের, প্রতিটা চরিত্রই হৃদয়ে গেঁথে আছে দর্শকের। শেকসপীয়ারের কিং লিয়ার করার খুব ইচ্ছে ছিল তার, অসম্ভব প্রিয় একটা চরিত্র- কিন্ত করা হয়ে ওঠেনি নানা কারনে। বয়স বেড়েছে, টেলিভিশন আর সিনেমা থেকে ছুটি নিয়েছেন, মঞ্চ থেকে ছুটি নেয়া হয়নি, সেটা যে তার ঘর, তার আরেকটা সংসার। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে তখনও তিনি ছুটে গেছেন মঞ্চে। অভিনয় করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, টিভির সাধারন অভিনয় কিংবা মঞ্চের লাউড অ্যাক্টিং- দুটোতেই তিনি ছিলেন অদ্ভুত রকমের সাবলীল।

সবাই প্রশ্ন করতেন, আপনার এত অর্জন, এত খ্যাতি, ব্যবসা আছে, তবু কেন এই বয়সে দুর্বল শরীর নিয়ে অভিনয় করতে আসেন? একটু তো বিশ্রাম দিতে পারেন শরীরটাকে? আলী যাকের হাসতেন, বলতেন- ‘ব্যবসা তো পেটের খিদে মেটায়, বুকের খিদে মেটাতে হবে না?’ ক্যান্সার আক্রান্ত শরীর নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে চোখের জলে সিক্ত হয়ে তিনি বলেছিলেন, মঞ্চই আমার প্রথম ভালোবাসা! সেই ভালোবাসার জায়গাটাকে আলী যাকের বরাবরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, সবার ওপরে রেখেছেন। 

অভিনয়ের পাশাপাশি টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। সমসাময়িক বিষয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা বই, শৌখিন আলোকচিত্রীও ছিলেন তিনি। বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি। যুক্তরাজ্যের রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণকালীন সদস্য। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার। সবশেষ গত বছর পেয়েছেন মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৯। আস্ত একটা ইন্সটিটিউশন ছিলেন এই গুণী মানুষটা।

আমরা শুধু আজ রবিবারের বড় চাচাকে হারাইনি আজ, হারিয়েছি কিংবদন্তী একজন অভিনেতাকে, হারিয়েছি অভিনয়ের একটা স্তম্ভকে, অনুপ্রেরণার এক জ্বলন্ত বাতিঘরকে, আমরা হারিয়ে ফেলেছি নূরালদিন, গ্যালিলিও কিংবা দেওয়ান গাজীকে। এই শূন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়। আলী যাকেরের মতো অভিনেতা যুগে যুগে জন্মায় না, হয়তো এক শতকে একজন জন্ম নেয়...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা