আলী বানাত ছিলেন বিত্তশালী এক তরুণ ব্যবসায়ী, কাটিয়েছেন এক বিলাসবহুল জীবন। কিন্তু যখনই জানলেন, তিনি স্টেজ ফোর ক্যান্সারে আক্রান্ত, তার আয়ু আছে মাত্র সাত মাস; সেই বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন আর্ত মানবতার পাশে...
কোনো একজন মনীষী বলেছিলন-
The Main difference between Life & death is, You can not enjoy your death. But, definitely, if you want, you can enjoy your life!
কথাটি নিদারুণ সত্যি। আমাদের জীবন অদ্ভুত এক মায়াজাল। আমাদের জন্ম, মৃত্যুর প্রয়োজনেই। নিশ্চিত সমাপ্তি জেনেও যে ছুটে চলা আমাদের, সে ছুটে চলায় অনিশ্চয়তা আছে, তৃপ্তি আছে, অতৃপ্তি আছে। এগুলোকে মেনে নিয়েই আমরা জীবন নিয়ে মাতামাতি করি, আশাবাদী হই, হতাশও হই। জীবনকে ভালোবাসতে থাকি। আজকে যে মানুষটিকে নিয়ে কথা বলবো, তিনিও তার জীবনকে দেখতেন ঠিক আমাদের মতনই।
মানুষটির নাম আলী বানাত৷ তাকে হয়তো অনেকেই চিনতেন না৷ বা, এখনো হয়তো অনেকেই চেনেন না। কিন্তু, কথা দিচ্ছি, এই লেখা শেষ হওয়ার পরে আপনি তাকে খুব নিবিড়ভাবে চিনে ফেলবেন। এটুকুই জানিয়ে রাখি প্রথমে, আলী বানাত বসবাস করতেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে। ছিলেন একজন তরুণ বিত্তশালী মানুষ, উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী। তার বিলাস-ব্যসন এর একটুখানি উদাহরণ দিই৷ তিনি যে জুতো জোড়া সবসময় ব্যবহার করতেন, তার দাম বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লক্ষ টাকা; একজোড়া স্যান্ডেলের প্রায় ৬০ হাজার টাকা। তিনি যে ব্রেসলেট ব্যবহার করতেন, সে ব্রেসলেটগুলোর প্রতিটির দাম প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। তাঁর নিত্য ব্যবহার্য ফেরারি স্পাইডার গাড়িটির দাম ৫ কোটি টাকা!
ভাবছেন, এ কী ভীমরতি করছি! একজন মানুষের বিত্তবৈভব প্রমাণ করার জন্যে কেন উঠেপড়ে লেগেছি! সত্যি বলতে উঠেপড়ে লাগিনি। কেন লাগিনি, তা একটু পরেই বুঝতে পারবেন। বলে রাখা ভালো, আলী বানাতের এই যে অর্থবিত্তের তথ্য জানালাম, এগুলো তিনি নিজেই ইউটিউবে একটা ভিডিও করে প্রকাশ করেছিলেন। যদিও সে ভিডিওটির মূল উদ্দেশ্য, তিনি যে বিশাল ধনী, সেটা প্রমান করা না। ভিডিওটির টাইটেল দেখলেই সেটা বুঝবেন আপনি। প্রবল খ্যাতি পাওয়া ও সাড়া জাগানো এই ভিডিওটির টাইটেল ছিলো; গিফট উইথ ক্যান্সার৷
ঠিকই ধরেছেন। আলী বানাতের ছিলো স্টেজ ফোর ক্যান্সার। ডাক্তার রা জানিয়ে দিলেন, খুব বেশিদিন আয়ু নেই তার। আলী বানাতের সম্বিৎ ফিরলো তখনই। বুঝলেন, এবার ফেরার পথ ধরার পালা। যখনই কোনো একটা বিষয়ে আমাদের ডেডলাইন বেঁধে দেওয়া হয়, সেই বিষয়টির গুরুত্ব তখন আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলী বানাতের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে।
স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন-
যে পৃথিবীতে তুমি জন্মেছো, মৃত্যুর আগে সেই পৃথিবীর অন্তত কোথাও হলেও একটু দাগ কাটার চেষ্টা কোরো।
আলী ভাবলেন, সারাজীবন নিজের জন্যেই করেছেন তিনি। নিজের কথাই তিনি ভেবেছেন। এবার মানুষের জন্যে কিছু করা যাক। সে কারণেই ক্যান্সার শনাক্ত হবার পর তিনি তার সমস্ত ব্যবসা, অর্থ-সম্পদ দান করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সারা পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মুসলিমদেকে সাহায্য করার জন্যে তিনি তার সমস্ত অর্থ-সম্পদ দান করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত মুসলিমদের জন্যে ‘মুসলিম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (এমএটিডব্লিউ)’ নামের একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। যে সংস্থা এখন পর্যন্ত প্রায় ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি ডোনেশন সংগ্রহ করেছে! যে টাকার পুরোটাই ব্যয় করা হয়েছে এবং হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সহায়সম্বলহীন মানুষদের জন্যে। হাসপাতাল, স্কুল, পুনর্বাসন প্রকল্প এর মতন কাজগুলো করা হচ্ছে এই দাতব্য সংস্থার অর্থ দিয়ে৷ আলী বানাত যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তিনি এ কাজগুলো সশরীরে তদারকি করতেন। তার মৃত্যুর পর 'গো ফান্ড মি' এই কাজগুলো দেখছেন। এ কারণে তিনি মৃত্যুর পরে আজও প্রাসঙ্গিক। যিনি মৃত্যুর পরেও মানুষকে সেবা করে যাচ্ছেন নিজের মত করে।
তিনি 'ক্যান্সার'কে বলেছিলেন স্রষ্টার উপহার। কেন একটি জীবনঘাতি রোগকে তিনি 'স্রষ্টার উপহার' বলছেন, তা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন-
খুব অল্প বয়স থেকেই যে জীবন কাটিয়েছি, সে জীবনে নিজের বিত্তবৈভবের কথাই চিন্তা করেছি। অন্য কারো কথা ভাবিইনি কখনো। যখন জানলাম আমার ক্যান্সার, আমি ধাক্কা খেলাম। প্রথমবারের মতন বুঝতে পারলাম, আমি মানুষের জন্যে করিনি কিছুই। আমার গোটা জীবনই 'আমি-কেন্দ্রিক'। ক্যান্সার এসে আমার দৃষ্টিভঙ্গিকেই পাল্টে দিলো।
এভাবেই একজন বিত্তশালী আলী বানাত হয়ে উঠলেন মানবিক আলী বানাত। যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন জীবদ্দশায়, তার পুরোটাই বিলিয়ে গেলেন অকাতরে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন সেই চিরকালীন সত্য; সাথে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না কিছুই। এই আপ্তবাক্যকেই 'ধ্রুব সত্য' মেনে আলী বানাত চলে গিয়েছেন জাগতিক সবকিছুকে রেখেই। তবে তিনি যা রেখে গিয়েছেন, তা অসহায় মানুষের জন্যেই রেখে গিয়েছেন তিনি। তার সব অর্থবিত্ত তিনি নিবেদন করেছেন, মানুষের উপকারের জন্যেই। আলী বানাত এভাবেই হয়ে গিয়েছেন এক দৃষ্টান্ত। মৃত্যুর পরেও তাই মানুষ তাকে এখনও শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বিনম্রচিত্তে।
একজন মানুষের সার্থকতা তো এখানেই। আলী বানাত ঠিক এখানেই সফল। মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় ও মানুষের মনে রাখায়৷
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন