সাত লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়েছে যে রোগীর কাছ থেকে, তার মৃতদেহ ঢাকার জন্য একটা চাদরও দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, এটা নাকি তাদের 'সিস্টেমে' নেই! তাহলে সিস্টেমে কি আছে? ভুতুড়ে বিল বানিয়ে রোগীদের গলা কাটা?

রোগী মারা গেছেন হাসপাতালে, স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েকজন হাসপাতালে গেলেন সেই মৃতদেহ বুঝে আনতে, দাফনের ব্যবস্থা তারাই করবেন। গিয়ে হতভম্ভ হয়ে তারা দেখলেন, স্ট্রেচারে নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে লাশ, মৃতদেহ ঢাকার জন্য একটা চাদরও দেয়া হয়নি হাসপাতালের পক্ষ থেকে! সাত লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়েছে যে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে, তার মৃতদেহ ঢাকার জন্য একশো টাকা দামের একটা চাদরও দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অমানবিক এই কাণ্ডটা ঘটেছে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল হাসপাতালে।

বাধ্য হয়েই পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায় মৃত সেই ব্যক্তির শরীর বুঝে নিতে হয়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের। তারাই নিজ খরচে বাইরে গিয়ে চাদর কিনে এনেছেন, সেই চাদরে মৃতদেহটা ঢেকে বয়ে নিয়ে নিজেদের নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছেন। তারপর শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেছেন। হাসপাতালের দায়িত্ব তো শেষ হয়ে গেছে বিল বুঝে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। রোগী মরে গেছে, তার গায়ে চাদর থাকলেই কি, আর না থাকলেই কি! এত ঝামেলা দেখার সময় আছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের?

স্বেচ্ছাসেবকরা হাসপাতালের লোকেদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন মৃতদেহের ওপর তারা একটা চাদরও দিলেন না? আনোয়ার খান মেডিকেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এটা নাকি তাদের সিস্টেমে নেই। এই দুটো শব্দ শুনে মনে প্রশ্ন জাগলো, আনোয়ার খান মেডিকেলের সিস্টেমে তাহলে কি কি আছে?

আমি বলি এই হাসপাতালের সিস্টেমে কি কি আছে- এখানে রোগীকে জিম্মি করে ভুয়া বিল দেখিয়ে টাকা আদায় করার সিস্টেম আছে, চার ঘন্টা অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগিয়ে আটদিনের বিল তোলার সিস্টেম আছে, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হয়েও রোগীর নামে লক্ষাধিক টাকার বিল তোলার সিস্টেম আছে, করোনার এই মুহূর্তে ব্যবসার জন্য সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি থেকে কোন নোটিশ ছাড়াই বেরিয়ে যাওয়াটা এদের সিস্টেমে আছে, শুধু নেই মারা যাওয়া রোগীর শরীর একশো টাকার একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখার সিস্টেমটাই।

মৃতদেহের ওপর চাদরটা নিয়ে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবকরাই

মাসখানেক আগে এক রোগী অভিযোগ করেছিলেন, ভর্তি হওয়ার পর থেকে রক্তের দুটি পরীক্ষা এবং তিনটি এক্সরে করে এবং নাপা ট্যাবলেট সরবরাহ করে মোট এক লাখ সত্তর হাজার টাকা বিল।করেছিল আনোয়ার খান মেডিকেল। অনেক কষ্টে সেই টাকা পরিশোধ করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন সেই রোগী। গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হবার পর তড়িঘড়ি করে প্রায় সোয়া এক লাখ টাকা ফেরত দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। একই সময়ে বেশ কয়েকজন রোগী ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ এনেছিলেন আনোয়ার খান মেডিকেলের বিরুদ্ধে।

করোনার চিকিৎসা দেয়ার নাম করে তারা রোগীপ্রতি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, এমনটাই ছিল ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। কারো কারো ক্ষেত্রে সাত-আট ঘন্টা অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়েছে, কিন্ত অক্সিজেনের বিল লিখে দিয়েছে রোগী ভর্তি হওয়া থেকে রিলিজ হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টার- এরকম ঘটনাও ঘটেছে! এগুলোই তাদের 'সিস্টেমে' আছে, সেবা করাটা নেই। মানুষকে জিম্মি করে কিভাবে টাকা আদায় করতে হয়, সেটার কোর্স কেউ করতে চাইলে আনোয়ার খান মেডিকেলের কাছে যাওয়া যেতে পারে।

অথচ এসব অভিযোগের কোন সুরাহা হয়নি। কারণ এই হাসপাতালের মালিক একজন সরকারদলীয় সাংসদ। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার জনসেবা করার কথা, অথচ তার প্রতিষ্ঠান যে মানুষের গলা কেটে টাকা আদায় করছে, অমানবিকতার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করছে, সেটা কি তিনি জানেন? না জানার তো কথা নয়!

আনোয়ার খান মেডিকেলের টাকা দরকার, অনেক টাকা। এত বেশি টাকা তাদের প্রয়োজন যে, একজন মৃত রোগী, যার কাছ থেকে সাত লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে, তার শরীরের ওপর একটা চাদর দেয়ার মানসিকতা যাদের হয় না, তারা আর যাই হোক, হাসপাতাল চালানোর অধিকার রাখে না, তাদের স্থান বরং কসাইখানায়। এদেশের মানুষ পান থেকে চুন খসলে ডাক্তারদের গালি দেয়, কসাই বলে ডাকে। ডাক্তারদের দোষ তারা কেন ৫০০/১০০০ টাকা ভিজিট নেন। অথচ স্বাস্থ্য খাতটাকে সেবার পরিবর্তে ব্যবসা খাতে পরিণত করার পেছনে মূল কালপ্রিট হচ্ছে হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলো। কসাই বলে কাউকে গালি দিতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে গালি দিন, ডাক্তারদের নয়।

অনেকেই আনোয়ার খান মেডিকেল বা এধরণের হাসপাতালগুলো বয়কট করতে বলবেন। তাতে কি লাভ? কয়টা বয়কট করবেন? আজ আনোয়ার খান, কাল ইউনাইটেড, পরশু রিজেন্ট, এভাবেই চলতে থাকবে। তারচেয়ে ফটোগ্রাফার প্রীত রেজা একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছেন ফেসবুকে, তিনি লিখেছেন- "আপনারা যদি কেউ এই হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাতায়াত করেন ১ টাকা/২ টাকা/৫ টাকা, যে যা পারেন প্লিজ, এই অসহায় লোকগুলোর পাশে দাঁড়ান। গরীব/অসহায়/দুঃস্থদের সাহায্য করলে অনেক অনেক সওয়াব হবে!" চলুন, সওয়াব কামানো যাক তাহলে, তাতে যদি এদের একটু লজ্জা হয়!

ছবি ও তথ্য কৃতজ্ঞতা- কাজী রিয়াজ রহমান আসিফ, মাস্তুল ফাউন্ডেশন

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা