৫'৫" লম্বা হতে হবে, পুরুষ হতে হবে, তাকবীরের সাথে টানা ৪০ দিন ২০০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে- এগুলো কি কোন চাকরিতে আবেদনের শর্ত হতে পারে? জুট মিলের ইঞ্জিনিয়ার পদের সাথে সুন্নতী জীবন বা কোরান পাঠের কি সম্পর্ক?

আশেপাশের আত্মীয় পরিজনের কাছে শুনতে হয় আমি নাকি প্রচণ্ড নৈরাশ্যবাদি। দেশ নিয়ে, মানুষ নিয়ে আশা জাগানিয়া কিছুই নাকি আমার চোখে পড়েনা। তা হবে হয়ত! কিন্তু যখনই স্বপ্ন দেখতে চাই, ভালো কিছু দেখে আশায় বুক বাঁধতে চাই তখনই তার বিপরীতে দাঁড়ানো অসত্য আর ভণ্ডামিতে ভরা কুকর্মগুলি আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ‘ফিরিবার পথ নাহি’।

এই তো বেশ কিছুদিন আগে আকিজ গ্রুপের বাটারের প্যাকেজিং এর প্রশংসা করছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে প্রতিষ্ঠাতা এসকে আকিজেরও প্রশংসা করলাম। সমস্যা হলো, যে দিকটা আমরা কেউ ভাবিনা তা হলো, একটা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক সাফল্য আর বোধের জাগৃতি এক বস্তু নয়। কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আয়ের জন্য নয়, তার সামাজিক কিছু দায়বদ্ধতা থাকে, সমাজকে কিছু দেওয়ার থাকে। কারন এই সমাজে বসবাসকারী মানুষেরাই তাদের ভোক্তা, তাদের ব্যবসার চালিকাশক্তি।

এবার যে কারণে এত ভূমিকা সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। আকিজ গ্রুপ তাদের জুট মিলসের জন্যে একটি ওয়াক-ইন-ইন্টারভিউ এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ফেসবুকে, পরে সেটা বিডি জবসেও দেওয়া হয়। সিভিল, মেকানিকাল এবং অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারের জন্যে।

চাকরির শর্তাবলির শুরুতেই রয়েছে প্রার্থীর উচ্চতা ৫’৫” হতে হবে এবং শুধুমাত্র পুরুষ। অক্ষরজ্ঞান রয়েছে এমন যে কেউই লাইনটার প্রচণ্ড বর্নবিদ্বেষী এবং লিঙ্গ বৈষম্যের কটু গন্ধ টের পাবেন। একটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে (নারী) বাদ দিয়ে চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া অতিমাত্রায় দৃষ্টিকটু, অন্যায্য এবং আইনত অপরাধ বটে। এবং একজন চাকরিপ্রার্থির শারীরিক উচ্চতা কি তার যোগ্যতার নির্ণায়ক হতে পারে? ৫’৫” এর কম কোন ব্যক্তি কি খুব মেধাবী একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেননা?

শর্তাবলীর পরবর্তী অংশ তো বলিহারি। শর্তাবলীগুলি এরকম-

  • তাকবীরে উলার সাথে ৪০ দিন চলমানভাবে ২০০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পেরেছেন অথবা আদায় করার জন্য দৃঢ়ভাবে নিয়ত করেছেন তারাই কেবলমাত্র আবেদন করতে পারবেন।
  • ঈমানদার, তাহাজ্জুদ নামাজী এবং তাকওয়া/আল্লাহ ভীতি সম্পন্ন প্রার্থী, যারা সুন্নতী জীবন-যাপন পালন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন তারাই কেবলমাত্র আবেদন করতে পারবেন।
  • যারা শুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করতে পারেন না এবং সপ্তাহে নূন্যতম ০৩-০৪ দিন অর্থসহ পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করেন না, তাদের আবেদন করবার প্রয়োজন নাই।

বলাই বাহুল্য, ওনারা একটি বিশেষ ধর্ম ছাড়া অন্যান্য ধর্মালম্বিদের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী নন। (বিডিজবসের বিজ্ঞাপনে তারা পরবর্তীতে একটি পয়েন্ট যোগ করেছেন অন্যান্য ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে উপরোক্ত ইসলামিক শর্তাবলী প্রযোজ্য নয়)। ভালো কথা। কিন্তু ধর্মীয় আচার পালন একজন মানুষের নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার, ঠিক যেমন একজন ব্যক্তি তার শোয়ার ঘরে কি কি করবেন, বাথরুমে গেলে কি করবেন, বা কি খাবেন কি খাবেননা, সেরকম। একজন ব্যক্তি দিনে কতবার নামায পড়ছেন, আরবি ভাষা পড়তে জানেন কিনা, জানলে শুদ্ধভাবে জানেন কিনা সেটা আরবির শিক্ষক, মক্তবের হুজুরের যোগ্যতার মাপকাঠি হলেও একজন ইঞ্জিনিয়ার এর যোগ্যতার মাপকাঠি কিন্তু কিছুতেই না। আকিজের জুট মিলে আসলে হয়টা কি, সেই প্রশ্ন মনে আসা কি সমীচীন না?

এই সেই চাকরির বিজ্ঞপ্তি

“যারা শুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করতে পারেন না এবং সপ্তাহে নূন্যতম ০৩-০৪ দিন অর্থসহ পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করেন না, তাদের আবেদন করবার প্রয়োজন নাই,” কেনরে বাবা? ধান ভানতে এই শিবের গীত কেন গাইতে হবে?

আসলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের সীমা বুঝি না। ধর্মীয় আচার প্রথা পালনে যত জোর দেই, অধর্মের বিনাশে তার সিকিভাগ আগ্রহ নেই আমাদের।

বিজ্ঞাপনটি দেখার পর আমি বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত মোবাইল নম্বরে ফোন করে এরকম অশ্লীল শর্ত জুড়ে দেওয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে মোবাইলের অপর প্রান্তে থাকা মহামনিষী আমাকে যুক্তি দেখান একটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান কি তার পছন্দমত কর্মী নিয়োগ দিতে পারেনা? অবশ্যই পারে। কিন্তু সেটা অবশ্যই দেশের মূল চালিকাশক্তি সংবিধান অগ্রাহ্য করে নয়। সংবিধান যেখানে ধর্ম, বর্ণ, নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে তুমি কে হে বাপু তাকে অগ্রাহ্য করো?

আর ব্যক্তিগত হলেই কি সব করা যায়? যখন ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করছে তারা, সেখানে কি লেখা থাকে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে যারা বা তাবলীগের চিল্লায় গিয়েছিল এবং একমাত্র পুরুষদের জন্য ব্যবহার্য? ব্যবসা করার বেলায় জাত যায়না কিছুতেই, কর্মী নেবার বেলায় শুধু ব্যক্তিগত ব্যবসা? 

অবশ্য অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকেই এরা যোগ্য মনে করেনা, মাত্র ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘিষ্ঠদের কোন বিচারে গুনবেন এরা। শুধু ব্যক্তিগত পশ্চাতদেশ বলেই যদি এখন অনেকেই রাস্তায় বসে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন সেটা কি অপরাধ হবে না? অপরাধ ভুলে যান, গন্ধেই তো ভবলীলা সাঙ্গ হবে মানুষের।

প্রসঙ্গক্রমে একটা গল্প বলি। ২০১৫ তে নেপাল গিয়েছিলাম। পশুপতিনাথ মন্দির দেখতে বের হলাম সকাল সকাল। সঙ্গে গাইড একটা ছেলে, নাম স্যেটে, ১৬-১৭ বছর বয়স। পৌঁছে দেখি ঠিক দরজায় বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ দাঁড়িয়ে, ক্যামেরা নিয়ে, বেশ অসহায় ভঙ্গীতে। জানতে পারলাম, হিন্দু ধর্মালম্বি ছাড়া কেউ ভেতরে যেতে পারবেনা। স্যেটেকে বললাম, ভাই স্যেটে তুমি তো আগে কিছু বলোনি, এত দূর এসে ফিরে যাবো? ঐ ছোট্ট ছেলেটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বলল, কি বলছেন ম্যাডাম, আসুন আমার সঙ্গে। পুরো পৃথিবীটাই তো ঈশ্বরের, সেই জগতে যদি সব ধর্মের লোককে উনি থাকতে দেন, তো মন্দিরে ঢুকলে কি হবে? এসব এদের বানানো! সেদিন স্যেটে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ঈশ্বর আর মানুষের এই বানানো ধর্মীয় আচার প্রথার তেমন কোন যোগসূত্র নেই।

এই লেখার নীচে অসংখ্য ইমানদার তাদের ইমানি জোর দেখাতে ছুটে আসবেন। অথচ এরাই আবার ভারতের নাগরিকত্ব বিল পাশ হলে আদর্শের বুলি ঝাড়েন ফেইসবুকে। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নিজের নামের শেষে ইসলাম থাকায় চাকরি না পেলে ‘ডিসক্রিমিনেশনের’ বুলি কপচান। তা ভাই, নিজের দেশে প্রতিষ্ঠানের জন্য নামাযি কর্মী খুঁজবেন, অন্য ধর্মের লোককে চাকরি দেবেন না আর অন্য কেউ একই কাজ করলে ছিঃ ছিঃ করবেন, ভণ্ডামি বেচারাও আপনাদের দেখে লজ্জা পায়!

দুঃখ হলো, দশ ক্লাস পর্যন্ত ধর্ম বই পড়েও ধর্ম আর অধর্মের পার্থক্যটুকুও মাথায় ঢোকেনি আমাদের বেশিরভাগ লোকের। এদের কাছে ধর্ম মানে বিদ্বেষ, ধর্ম মানে ঘৃণা, অন্যকে ঘৃণা, অন্যের বিশ্বাসকে ঘৃণা। একেকজন ঘৃণার টাইম বোমা!

অথচ বিধাতার এই ধরাধামে তিনি কারও সঙ্গে বৈষম্য করেননি। এসব দেখে শুনে আপনি আমি যারা চুপ করে থাকি তারাও কি সমান অপরাধে অপরাধী নই? বুদ্ধিহীনের কাণ্ডজ্ঞান কি আসবে কোনদিন?

বুদ্ধি যোগাতে কাজী নজরুল ইসলামও চেষ্টা করেছিলেন বটে, লিখেছিলেন--

এ দুনিয়া পাপশালা,

ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূণ্য-ছালা!

হেথা সবে সম পাপী,

আপন পাপের বাট্‌খারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি!

জবাবদিহির কেন এত ঘটা যদি দেবতাই হও,

টুপি প’রে টিকি রেখে সদা বল যেন তুমি পাপী নও।

পাপী নও যদি কেন এ ভড়ং, ট্রেডমার্কারধুম?

পুলিশী পোশাক পরিয়া হ’য়েছ পাপের আসামী গুম।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা