"বারোটা বছর লেগেছে আমাদের, এয়ারবিএনবিকে আজকের জায়গায় আনতে। অথচ একটা মহামারী, যার ওপর মানুষের কোন হাত নেই, সেটা মাত্র দেড় মাসের মধ্যে আমাদের ধ্বংস করে দিলো!"

ভাবুন তো, নিজের সারা জীবনের অর্জন করা টাকায় তিল তিল করে একটা ভবন গড়েছেন আপনি, নিজের শেষ বয়সের সম্বল ভেবে। সেই ভবনটা যদি আচমকা ভূমিকম্পে ধ্বসে যায়, কেমন লাগবে আপনার? ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তো সেরকমই। একটা কোম্পানী, একটা ব্র‍্যান্ড, একটা স্টার্টআপকে সাফল্যের চূড়ায় তুলতে যুগের পর যুগ লেগে যায়। রক্ত পানি করা পরিশ্রম আর সংগ্রামের অজস্র গল্প লেখা হয় নেপথ্যে, কত ত্যাগ আর বিসর্জনের পথ মাড়িয়ে আসে সফলতা। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানটাই যদি মানবসৃষ্ট কোন কারণ ছাড়া, কারো কোন ভূমিকা ছাড়াই অল্প কয়েকটা দিনের মধ্যে পথে বসে যাওয়ার মতো অবস্থায় চলে যায়- সেই কষ্টটা কি মেনে নেয়ার মতো হয়? 

এয়ারবিএনবি'র (এয়ার বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট) সিইও ব্রায়ান চেসিস্কির কথা শুনলে মন খারাপ হবে যে কারো। সিএনবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রায়ান বলছিলেন, "বারোটা বছর লেগেছে আমাদের, এয়ারবিএনবিকে আজকের জায়গায় আনতে। অথচ একটা মহামারী, যার ওপর মানুষের কোন হাত নেই, সেটা মাত্র দেড় মাসের মধ্যে আমাদের ধ্বংস করে দিলো! পর্যটন সেক্টরটা ধ্বংস হয়ে গেছে, এটাই বাস্তবতা। সেইসঙ্গে আমাদেরকেও ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আমাদের ব্যবসার যে মডেলটা ছিল, সেটা আর কখনও ফিরে আসবে না। টিকে থাকার সম্ভাবনা তাই খুব ক্ষীণ।" 

ড্রয়িংরুমে একটা কার্পেট এক রাতের জন্য এক অতিথির কাছে ভাড়া দেয়ার আইডিয়া থেকে শুরু হয়েছিল এয়ারবিএনবির যাত্রা। জো গেবিয়ার আর ব্রায়ান চেসিস্কি- এই দুইজনের হাত ধরে শুরু হওয়া কোম্পানীটা নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে পেয়েছিল সফলতার দেখা, পৌঁছে গিয়েছিল চূড়ায়। হোটেল বাণিজ্যের ধরণটাই বদলে দিয়েছিল এয়ারবিএনবি, পর্যটকদের, বিশেষ করে বাজেট ট্যুরিস্টদের কাছে হয়ে উঠেছিল আস্থার আরেক নাম। বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সেই প্রতিষ্ঠানটা এখন ধুঁকছে, কর্মী ছাটাই হয়েছেন অজস্র, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পাবলিক প্রোপার্টিতে পরিণত হবে এয়ারবিএনবি। 

এয়ারবিএনবির প্রতিষ্ঠাতা তিনজন

মহামারীর এই সময়ে আর্থিকভাবে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে এয়ারবিএনবি। লাখ লাখ রিজার্ভেশন বাতিল হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটির, মুনাফা তো দূরে থাক, আয় এসে ঠেকেছে তলানিতে। কর্মীদের বেতন পর্যন্ত দেয়া যাচ্ছে না, বাধ্য হয়ে ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে হয়েছে তাদের। মহামারীর আগ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। প্রতিষ্ঠানটিকে শেয়ার বাজারে আনার প্রস্তুতিও এগুচ্ছিল। এই বসন্তেই ‘ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং” বা আইপিও ছাড়ার কথা ছিলো প্রতিষ্ঠানটির। বর্তমান পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার পর পিছিয়ে গেছে সব পরিকল্পনা। হতাশ সিইও ব্রায়ান চেসিস্কি কর্মীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, বলেছেন, 'আপনারা ভাববেন না যে এটা আপনাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা আমাদের, আপনারা কোন দোষ করেননি।' 

২০০৭ সাল, দুই তরুণ ডিজাইনার জো গেবিয়ার আর ব্রায়ান চেসিস্কি ভেবেছিলেন, ডিজাইনারদের সম্মেলন উপলক্ষ্যে শহরে আসা ডিজাইনারদের মধ্যে একজনকে লিভিংরুমের তোষকে থাকতে দিলে অল্প কিছু ডলার ভাড়া পাওয়া যাবে। বাড়তি আয়ের এই ব্যবস্থাটাকেই পরে ব্যবসায়িক আইডিয়াতে রূপ দেয়ার কথা ভাবলেন দুজন। সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে যুক্ত হলেন তাদের আরেক বন্ধু নাথান ব্লেচারজিক। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। 

এয়ারবিএনবির ধারনাটা ছিল বেশ মজার। ধরুন, আপনি ঢাকাতে পরিবার সহ থাকেন। আপনার একটা রুম মাঝে মাঝেই ফাঁকা পরে থাকে। ইচ্ছে করলেই আপনি আপনার বাসার ফাঁকা রুমটি এয়ারবিএনবিতে অ্যাড করতে পারেন; সাথে আপনি বলে দিতে পারেন যে রুমের সাথে আপনি আর কি কি সুবিধা দিতে চান ভাড়াটিয়াকে; যেমন রুমের সাথে অ্যাটাচড টয়লেট আছে, বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ওয়াই ফাই আছে, যিনি ভাড়া নেবেন তিনি চাইলে বাসার অন্যান্য জায়গাতেও ঘুরে বেড়াতে পারেন, টিভি দেখতে পারেন, রান্নাঘর ব্যবহার করতে পারেন, এমনকি সামান্য বেশি টাকা দিলে আপনি খাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। 

এয়ারবিএনবির ওয়েবসাইট

অন্যদিকে যে লোকটি ঘুরতে বের হবেন, তিনি আগে থেকেই যেখানে যেতে চান সেই জায়গা বা তার আশেপাশে তার পছন্দনীয় বাসা খুঁজে নিতে পারে, সেই ব্যবস্থা আছে এয়ারবিএনবিতে। অর্থাৎ, ঘুরতে বের হলেও যে কেউ পেয়ে যাবেন ঘরোয়া একটা আমেজ। আর নিশ্চিন্ত থাকার জায়গা। কাজ বা বেড়ানো শেষে যখন আপনি চলে যাবেন, তখন বাসা বা রুমটা আপনার কেমন লাগলো, সেটাও লিখে দিতে পারবেন এয়ারবিএবির ওয়েবসাইটে কিংবা অ্যাপের মাধ্যমে, যেন পরবর্তীতে যিনি এই বাসা বআ রুমটি ভাড়া নিতে চান তিনি বুঝতে পারেন সেটি কেমন ছিল।

যাত্রা শুরুর পরের গল্পটা ছিল সংগ্রামের, ত্যাগের, অপেক্ষার, লড়াইয়ের ময়দানে টিকে থাকার, প্রতিযোগীতায় বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাপিয়ে যাওয়ার। আমেরিকায় তখন প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের ক্যাম্পেইন চলছে, সেটাকে কেন্দ্র করে ঘর ভাড়া তো দিলেনই তারা, সঙ্গে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নামে আলাদা আলাদা ব্রেকফাস্ট প্যাকেজ নিয়ে এলেন। এয়ারবিএনবি নামটা মূলত সেখান থেকেই এসেছে, বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট দুটো সার্ভিসই পাওয়া যায় এখানে। রাতে থাকার জায়গা তো আছেই, সকালের নাস্তাটাও সার্ভিসের মধ্যেই। এই আইডিয়াটা বাজীমাত করলো, দুই প্রার্থী ওবামা আর ম্যাককেইনের বক্তৃতা শুনতে শহরে আসা লোকজনকে আকৃষ্ট করে ভালো অংকের ব্যবসা করতে সক্ষম হলেন তারা। 

পথে পথে ঘুরে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন তারা, শুরুতে খুব ছোট ছোট অংকের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বুঝিয়েছেন, এয়ারবিএনবিতে হোস্ট হওয়ার উপকারীতা। কোম্পানীতে দক্ষ কর্মী নিয়ীগ দিয়েছেন, বিপণন আর প্রচারণায় দারুণ সব টেকনিক খাটিয়েছেন। সেবা গ্রহীতা আর সেবা দাতা, দুজনের মধ্যে থার্ড পার্টি হিসেবে দারুণভাবে সেতুবন্ধন রচনা করেছে এয়ারবিএনবি। জনপ্রিয়তা বেড়েছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে, দামী বিলাসবহুল হোটেল রুমের পরিবর্তে বাজেট ট্রাভেলাররা ঝুঁকেছে এয়ারবিএনবির দিকে। আমেরিকা থেকে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এমনকি এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে এয়ারবিএনবির যাত্রা, বিলিয়ন ডলারের কোম্পানীতে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। 

ব্রায়ান চেসিস্কি ও জো গেবিয়ার

এবছরের জানুয়ারীতে এয়ারবিএনবির মূল্যমান ছিল প্রায় চল্লিশ বিলিয়ন ডলার। দেড়শো মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এপর্যন্ত সেবা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে। প্যান্ডেমিক সিচুয়েশন শুরু হবার আগে প্রতি রাতে এয়ারবিএনবির সার্ভিস নিতো গড়ে দুই মিলিয়ন মানুষ! এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহের মূল কারণটা অবশ্যই অর্থনৈতিক, সেইসঙ্গে বৈচিত্র‍্যও একটা বড় কারণ ছিল। সাজানো গোছানো বেডরুম বা লিভিংরুমই নয়, ট্রি-হাউজ, ইগলু, সাজানো গুহা, লাইটহাউজ, ইয়ট, প্রাসাদ ও প্রাইভেট আইল্যান্ড- এসব জায়গা ভাড়া করেও রাত কাটানো যেতো এয়ারবিএনবির মাধ্যমে। 

এই প্রতিষ্ঠানটা মালিকদের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, যারা অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখেছিলেন, দারুণ সব পরিকল্পনা সাজিয়ে এয়ারবিএনবিকে আজকের অবস্থানে এনেছেন, প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নিজেদের রক্ত পানি করে খেটেছেন, তাদের নিয়ন্ত্রণে এটি থাকবে না হয়তো কিছুদিন পর থেকে, শেয়ার বিক্রি করে পাবলিক প্রোপার্টিতে পরিণত হবে এয়ারবিএনবি। একেকটা স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের কাছে সন্তানের মতো; ভীষণ যত্নে, অনেক কষ্ট করে এগুলোকে বড় করা হয়। সাফল্যের চূড়ায় থাকা অবস্থায় কোন ভুল ছাড়াই শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়ে সন্তানের এমন পরিণতি কোন বাবা কি মেনে নিতে পারেন? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা