এলি কোহেন: 'মোসাদ' এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এজেন্ট হওয়ার রুদ্ধশ্বাস গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে নিজের দেশ থেকে হয়েছিলেন বিতাড়িত। ইসরায়েলে এসে 'মোসাদ' এ যুক্ত হওয়ার আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু সে আবেদন বাতিল করে দেয় মোসাদ। সেখান থেকেই এলি কোহেন হয়ে উঠেন মোসাদের অন্যতম সেরা ফিল্ড এজেন্ট। কিন্তু কীভাবে? তা নিয়েই গল্প...
'স্পাই' শুনলেই আমাদের মধ্যে বেশ একটা রুদ্ধশ্বাস থ্রিল কাজ করে। তাছাড়া গুপ্তচরদের জীবনটাও তো এরকমই বারুদে ঠাসা, এ্যাকশনে ভরা। এরকমই এক গুপ্তচর ছিলেন এলিয়াহু বেন শাল কোহেন। অথবা, এত খটমট নাম যদি ভালো না লাগে- এলি কোহেন। যিনি ছিলেন একজন ইসরায়েলি স্পাই। ষাটের দশকে যিনি গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশি ওঠাবসা করতেন সিরিয়ান রাজনৈতিক ও মিলিটারিদের উচ্চপর্যায়ের লোকজনের সাথেও। সেই মানুষটিকেই জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মেনে নিতে হয়েছিলো এক অন্তিম পরিণতি। আজ জানবো সেই মানুষটির গল্পই।
এলি কোহেনের জন্ম ইজিপ্টের আলেকজান্দ্রিয়াতে। জন্মসুত্রে তিনি ছিলেন ইহুদি। পড়াশোনা করেছেন কায়রো ফারোক ইউনিভার্সিটিতে৷ সেসময়ে একটা নিয়ম ছিলো, ইজিপ্টে বসবাসকারী তরুণ ইহুদিরা প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ইজিপশিয়ান সরকারকে দেবে। কোহেন সেই টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে ইজিপশিয়ান আর্মিতে নেওয়া হয়। এটা ছিলো টাকা না দেওয়ার বিকল্প পদ্ধতি। কিন্তু আর্মি থেকেও তাকে বের করে দেয়া হয় একসময়ে।বলা হয়, সে বিশ্বস্ত না। এরপর অর্থের অভাবে বাধ্য হয়ে কোহেনকে একসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাড়তে হয়। তার কলেজ ছাড়ার পেছনে 'মুসলিম ব্রাদারহুড' নামের এক সংগঠনও বেশ ভালো ভূমিকা রাখে সেসময়ে।
পরবর্তীতে কোহেনের বাবা আর কোহেনের তিন ভাই ইজিপ্ট ছেড়ে ইসরায়েলে চলে যায়। কিন্তু কোহেন থেকে যায় ইজিপ্টে। পড়াশোনা শেষ করার জন্যে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে ইহুদিদের কিছু আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করতো। যে আন্দোলনের খবর পরবর্তীতে সরকার জানতে পারে এবং কোহেনসহ অনেককেই গ্রেফতার করা হয়। কোহেনের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ আনা হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিলো, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ। অবশ্য যেটা ইজিপশিয়ান সরকার শেষপর্যন্ত প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন।
আস্তে আস্তে ইজিপশিয়ান সরকারের সাথে ইহুদিদের দ্বন্দ্ব বাড়ছিলো। ধরপাকর, হামলা, সহিংসতার ঘটনাও বাড়ছিলো পাল্লা দিয়ে। অনেক ইহুদিকে জোরপূর্বক দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কোহেনও একসময়ে দেশ ছাড়েন।
কোহেন চলে আসেন ইসরাইলে। ইসরাইল এ এসে তিনি চাকরী পান মিলিটারিতে, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট হিসেবে। এই কাজ ছিলো একঘেয়েমির কাজ। বিরক্ত লাগতো কোহেনের। সে চাচ্ছিলো 'মোসাদ' এর এজেন্ট হওয়ার জন্যে। কিন্তু 'মোসাদ' এ যুক্ত হওয়ার আবেদন জানালেও তাকে বাতিল করে বিশ্বসেরা এই গুপ্তচর সংস্থা। এ ঘটনায় রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে কোহেন মিলিটারি-ইন্টেলিজেন্স এর চাকরীও ছেড়ে দেয়। পরবর্তী কিছুদিন সে একটা সাধারণ চাকরী করে কাটায়। বিয়েও করে নেয় এরমধ্যে।
তবে এরইমধ্যে আসে এক সুখের সংবাদ। 'মোসাদ' থেকে ডাক পড়ে তার। সিরিয়ান সরকারের কিছু বিষয়ে অভিযান চালানোর জন্যে দেখা হচ্ছিলো সম্ভাব্য প্রার্থীদের। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কাউকে না পাওয়ার পর 'মোসাদ' এর ডিরেক্টর জেনারেল চোখ বোলানো শুরু করেন বাতিল প্রার্থীদের লিস্টে। অনুসন্ধান চালাতে চালাতে পাওয়া যায় কোহেনকে। কোহেনকে টানা দুই সপ্তাহ মনিটর করা হয়। তারপর তাকে জানানো হয়, মোসাদ তাকে তাদের এজেন্ট হিসেবে সিলেক্ট করেছে। তবে টানা ছয়মাস তাকে 'মোসাদ ট্রেনিং স্কুল' এ কোর্স করতে হবে। ছয় মাস কোর্সের পর কোহেন 'কাতসা' অথবা 'ফিল্ড এজেন্ট' হিসেবে কাজ করার ছাড়পত্র পান।
এরপর তাকে 'সিরিয়ান ব্যবসায়ী'র এক নকল পরিচয়পত্র দেওয়া হয়, যিনি অনেক বছর আর্জেন্টিনায় কাটিয়ে এখন সিরিয়ায় ফিরছেন। সিরিয়ায় যাওয়ার আগে কোহেন আর্জেন্টিনাতেও যান। থাকেন কিছুদিন। সেখানকার আরব কমিউনিটির সঙ্গেও কিছুদিন 'হাই-হ্যালো' করে আসেন৷ কোহেন এরপর সরাসরি দামাস্কাসে যান। মোসাদ এর প্ল্যান অনুযায়ী কোহেনের কাজ ছিলো হাই-র্যাংকিং সিরিয়ান পলিটিশিয়ান, মিলিটারি অফিসার, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রাখা এবং তাদের ব্যক্তিগত ও অফিশিয়াল তথ্য যোগাড় করা। এই কাজের জন্যে কোহেন প্রথমদিকে সবার সাথে সম্পর্কস্থাপনে মনোযোগী হলেন। আস্তে আস্তে অনেকের সাথে পরিচয় করে নিজের রাডার বাড়ালেন। তার বাড়িতে নিয়মিত পার্টি হতো। রাজনীতিবিদরা, মিলিটারির বড় বড় অফিসারেরা সেখানে আসতেন। প্রচুর তরল ও নারীদেহের ব্যবস্থা রাখতেন কোহেন। আর পার্টিতে কে কী বলছে, সবকিছুর খবর রাখতেন তিনি। শুনতেন সবার প্ল্যান। মাতলামির ভান করতেন। হাঁড়ির খবর বের করে দিতো সবাই মাতালের সামনে। কিন্তু কান খাড়াই থাকতো কোহেনের।
এভাবে প্রচুর তথ্য যোগাড় করেন তিনি। সেগুলো গুপ্তচিঠি, রেডিও অথবা বিশ্বস্ত কিছু মানুষের মাধ্যমে ইসরায়েলে পাঠাতেন তিনি। তবে তার পাচার করা নানারকম তথ্যের মধ্যেও 'গোলেন হাইটস' এ সিরিয়ান মিলিটারির দুর্গের অবস্থান বিষয়ক যে তথ্য তিনি দিয়েছিলেন ইসরায়েলকে, সে তথ্য একটু বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। এ তথ্যে ভর করেই মাত্র দুই দিনে 'গোলেন হাইটস' এর দুর্গ দখল করে নিয়েছিলো ইসরায়েল।
তবে কোহেন বুঝতে পারছিলো সিরিয়ায় আর বেশিদিন থাকা যাবে না। কারণ তার গতিবিধিকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখছিলো। এরইমধ্যে একবার কোহেন ইসরায়েলে ফেরেন। তার তৃতীয় সন্তানের জন্ম হচ্ছিলো তখন। সেটা দেখার জন্যেই দেশে ফেরা তার। তিনি মোসাদকে জানানও, সিরিয়ায় তার থাকা অনেকের কাছেই সন্দেহ সৃষ্টি করছে। মোসাদ তাকে শেষবারের মতন সিরিয়ায় যেতে বলে। কোহেন দেশ ছাড়ার আগে তার স্ত্রী'কে বলে যায়, এটাই শেষ মিশন। এরপর এলে আর ফিরে যাওয়া নেই।
এলেন সিরিয়ায়৷ এবং ধরা পড়লেন কিছুদিনের মধ্যেই। তিনি তখন ইসরায়েলের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছিলেন রেডিওতে। রেডিও'র সেই ফ্রিকোয়েন্সি ট্র্যাক করে কোহেনকে ধরা হয়। এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। তাকে ক্রমাগত টর্চার করা হয় বেশ কিছুদিন। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। যদিও ইসরায়েল, আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করে সিরিয়ার হাত থেকে কোহেনকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে চাইছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স... সবাই সুপারিশ করেছিলো কোহেন'কে ছেড়ে দেয়ার জন্যে। কিন্তু ছাড়া হয়নি তাকে আর। প্রকাশ্যে ঝুলিয়েই কোহেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর আগে কোহেন তার স্ত্রী'কে একটি চিঠি লিখে যান-
আমি তোমাকে অনুরোধ করছি নাদিয়া, যে মানুষটি চলে গিয়েছে, তাকে নিয়ে আর কেঁদোনা। লাভ নেই। তুমি নিজের দিকে তাকাও। তুমি সুখী হও।
পরবর্তীতে কোহেনের লাশটাও আর ফেরত দেয়নি সিরিয়া। তিনবার তাকে দাফন করা হয় যাতে ইসরায়েল তাকে কোনোভাবেই খুঁজে না পায়। সরকার, কোহেনের পরিবার অনেকবার সিরিয়ান সরকারকে বলেছিলো, শেষ কয়টা হাড়ের টুকরো হলেও যাতে ফেরত দেয়া হয়। কেউ কথা শোনেনি।
ইসরায়েলের ন্যাশনাল হিরো হিসেবে, নিজের নামে কয়েকটি রাস্তা, স্থাপনা ও গোলেন হাইটসে নিজের নামে একটি দূর্গের নামকরণ নিয়ে কোহেন এখনো শ্রদ্ধায় বেঁচে আছেন ইসরাইলিদের হৃদয়ে৷ এখনো ইসরায়েলের সেরা ফিল্ড এজেন্টের কথা উঠলে এলি কোহেনের নাম সেখানে প্রথমেই চলে আসে। পরবর্তীতে কোহেনের জীবনগল্প নিয়ে সিনেমা হয়েছে। নেটফ্লিক্স সম্প্রতি টিভিসিরিজও করেছে।
এলি কোহেন এভাবেই এখনো হয়ে আছেন প্রাসঙ্গিক।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন