দেব রাজনীতির পঙ্কিলে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছেন, তিনি ব্যতিক্রমী একজন! লকডাউনে নেপালে আটকে পড়া হাজারো ভারতীয় নাগরিক দেশে ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন শুধু তার কারণেই, নিজের খরচে সবাইকে ঘরে ফেরাচ্ছেন দেব...

খ্যাতির চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দীপক অধিকারী ওরফে দেব যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজনীতির মাঠে পা রেখেছিলেন, তখন আশেপাশের সবাই ভয় দেখিয়েছিলেন তাকে। বলেছিলেন, যেটা করছিলি সেটাই কর, দুই নৌকায় পা দিতে যাস না, ধ্বংস হয়ে যাবি, এই রাস্তায় একবার এলে পেছনে ফেরা যায় না আর। দেব অনেক ভেবেছেন, তারপর মমতাকে হ্যাঁ বলেছেন, পা রেখেছেন রাজনীতির পঙ্কিলে ভরা মঞ্চে। ছয় বছর ধরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের ঘাটাল এলাকার সাংসদ, আনাড়ি হাতে দক্ষভাবেই সামলাচ্ছেন সবকিছু। মজার ব্যাপার কি জানেন? পশ্চিমবঙ্গের ৪২ জন সাংসদের মধ্যে এই করোনাকালে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে দেখা যাচ্ছে দেবকেই। দিন-রাত এক করে তিনি ছুটছেন, দাঁড়াচ্ছেন অসহায় মানুষের পাশে। 

লকডাউনের কারণে নেপালে আটকা পড়ে আছেন হাজারো ভারতীয় নাগরিক। এদের বেশিরভাগই বাঙালি, স্বর্ণকারের কাজ করেন সেখানে। লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ায় ফিরতে পারেননি দেশে। টাকাপয়সাও ফুরিয়ে এসেছে, কয়েক মাস ধরে পার করছেন মানবেতর জীবন। দেব খোঁজ পেয়েছেন এদের, কেন্দ্র সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপর নিজের উদ্যোগেই এই মানুষগুলোকে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করেছেন। বাস ভাড়া করেছেন নিজের টাকায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই ভারতীয় নাগরিকদের দেশে ফেরানোর অনুমতি বের করেছেন। দেবের ভাড়া করা বাস ছুটে গেছে ভারত-নেপাল সীমান্তে। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

প্রথম বাসে চড়ে নেপালে আটকে পড়া দু'জন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা সহ মোট ৩৬জন পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছেন। এই পরিযায়ী শ্রমিকের প্রত্যেকে নেপালে স্বর্ণশিল্পের কারিগর ছিলেন। ঠিকঠাক কাগজ পত্র না থাকায় হাজার চেষ্টাতেও বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না। আটকে পড়েছিলেন ভারত-নেপাল সীমান্তে। খবরটা শুনতে পেয়েই আসরে নামেন দেব। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তড়িঘড়ি করে অনুমতি জোগাড় করলেন। গত মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটি স্পেশাল বাস ছাড়লো নেপাল সীমান্তের উদ্দেশে। বুধবার সীমান্তে পৌঁছায় সেটি। বৃহস্পতিবার ওই ৩৬ জনকে নিয়ে দেশে ফিরেছে স্পেশাল বাসটি। আপাতত ওই ৩৬ জনেরই লালারসের নমুনা সংগ্রহ করেছেন স্বাস্থ্য প্রতিনিধিরা, সবাইকে রাখা হয়েছে কোয়ারেন্টাইনে। 

তারপর থেকেই দেবের কাছে একের পর এক পরিযায়ীদের পরিবার থেকে অনুরোধ আসা শুরু করে। পেটের দায়ে যারা পশ্চিম বাংলা থেকে নেপালে কাজ করতে গিয়েছিলেন, এমন মোট ১০০০ জন পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে এখন অবদি। এদের বেশিরভাগই ঘাটালের বাসিন্দা। ইতিমধ্যেই সাতটি বাসের বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন দেব। সবাইকে একেবারে নিয়ে আসা সম্ভব নয়, তাই বাসগুলো নিজেরাই দফায় দফায় অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে নেপাল থেকে তাদের নিয়ে আসবে। শুক্রবার বিকেলেই এই নাগরিকদের ফেরানোর ব্যাপারে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেয়েছেন দেব। 

এখানেই থেমে থাকেননি দেব। ঘাটালের ৫০ জন শ্রমিক জম্মু সীমান্তে আটকে পড়েছেন। বাড়ি ফেরার জন্য বাসের বন্দোবস্ত তারা নিজেরাই করেছিলেন। কিন্তু বাস নিয়ে রাজ্যের সীমান্ত পেরিয়ে আসার অনুমতি পাননি, পুলিশ আটকে দিয়েছে বাস। ফলে তিন দিন ধরে সেখানেই আটকে রয়েছেন তারা। সেই মানুষগুলোকেও বাড়ি ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ। দেব যাদের বাড়ি ফিরতে সাহায্য করছেন, তাদের সবাই যে তারই সাংসদীয় এলাকার বাসিন্দা- এমনটা নন। দেব এসব বাছবিচার করছেনও না। তার কাছে সবাই মানুষ, সবাই বিপদগ্রস্ত, তিনি তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন সাধ্যমতো। 

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন দেব

ইতিমধ্যেই দুবাইয়ে আটকে থাকা দেড়শো অভিবাসী ভারতীয় যোগাযোগ করেছেন তার সঙ্গে। দেব সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন, সাড়া না পেলে হয়তো বিমান ভাড়া করে পাঠিয়ে দেবেন দুবাইয়ে, নিয়ে আসবেন আটকে পড়া ভারতীয় নাগরিকদের। দেব বলছিলেন, “জানি না আমি কতটা পারব। তবে আমি সবরকমভাবে পাশে থাকব। এটা নিজের ঢাক নিজে পেটানোর সময় নয়! বরং দুস্থ মানুষগুলো যাঁরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর সময়।”

সাংসদ হিসেবে দেবের কোষাগারে এক কোটি রূপি জমা ছিল মার্চের শুরুতে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়া মাত্রই বিন্দুমাত্র না ভেবে পুরো টাকাটা স্বাস্থ্যখাতে খরচ করার নির্দেশ দিয়েছেন দেব, এক কোটি রূপির পুরোটাই তুলে দিয়েছেন প্রশাসনের হাতে। সেই টাকায় তার সংসদীয় এলাকার হাসপাতালে আইসোলেশন বেড স্থাপন করা হয়েছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হয়েছে, হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের পিপিই-মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি সংসদীয় এলাকার আর কোথাও এমন নজির দেখা যায়নি। 

অনভিজ্ঞ-আনাড়ি হয়েও দারুণভাবে সব সামলাচ্ছেন দেব

মার্চে লকডাউন শুরুর পরে দেব নিজের পকেট থেকে ত্রাণ বিতরণ করেছেন কয়েক দফা। দেবের দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাকর্মীরা চাইছিল, ত্রাণ বিতরণের অনুষ্ঠানে দেব উপস্থিত থাকবেন, একটা প্রচারণাও হয়ে যাবে। দেব কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন অনুষ্ঠান করতে, বলেছেন, তাতে সামাজিক দূরত্ব বলে কোন বস্তু থাকবে না আর। ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে তিনি এক-দেড় মিনিট কথা বলেছেন, তারপর ত্রাণ তুলে দেয়া হয়েছে যার যার হাতে। হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল তার, সেখানেও তিনি ভিডিও কনফারেন্সে কাজ সেরেছেন। তিনি জনপ্রিয় তারকা, কোথাও গেলে ভীষণ ভীড় হয়, তাতে রোগীরা যাতে অসুবিধায় না পড়েন, সেটা দেব সবার আগে ভেবেছেন।

দেবকে নবান্নে (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন) ডেকে নিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন- 'তোমার তো মানুষের জন্যে কাজ করা উচিত, জনপ্রিয়তাটাকে কাজে লাগাও।' দেব সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন কি চমৎকারভাবে! যারা হাজারো ভয় দেখিয়েছিল, বলেছিল, তুই পারবি না, হারিয়ে যাবি নোংরামির আসরে, তাদের মুখ এখন চুপ। দেব হারাননি, বরং রাজনীতির ময়দানে উজ্জ্বল এক ব্যতিক্রম হিসেবে প্রমাণ করেছেন নিজেকে। অভিনেতা দেবের অনেক খুঁত আছে, তাকে আপনি পছন্দ না করতেই পারেন। কিন্ত মানুষ দেব, বা রাজনীতিবিদ দেবকে আপনার ভালো বাসতেই হবে, তাকে অপছন্দ করার কোন উপায় দেব নিজেই রাখছেন না... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা