আবু বকর আল বাগদাদী: যার মাথার দাম ছিল দুইশো কোটি টাকা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পঁচিশ মিলিয়ন, বা আড়াই কোটি ডলার, টাকার অঙ্কে কত হয় একবার হিসেব করে দেখুন। ২১০ কোটি টাকারও বেশি। এই বিশাল অঙ্কের টাকা মার্কিন প্রশাসন পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করেছিল শুধু একজন মানুষকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে। তাঁর কোনো খোঁজ (অবশ্যই নিশ্চিত খবর হতে হবে) দিতে পারলেই এই পুরস্কার দেয়া হবে খবরদাতাকে!
যার মাথার মূল্য এত টাকা, তাঁর নাম আবু বকর আল বাগদাদী, জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের প্রধান। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবী অনুযায়ী, যাকে সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে হত্যা করা হয়েছে! আবু বকর আল বাগদাদী আমেরিকার জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, সেটা সিআইএ'র মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্ট দেখলেই বোঝা যায়। গত কয়েক বছর ধরেই বাগদাদীর নামটা ঝুলছিল সবার ওপরে। এই লোকের কারণেই অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, হাজারো নিরপরাধ মানুষ মারা পড়েছে, লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়ে শরণার্থী জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে এখনও। জঙ্গিবাদের কালো থাবা মধ্যপ্রাচ্য ছাপিয়ে আফ্রিকা, ইউরোপ বা সুদূর বাংলাদেশেও থাবা বসিয়েছে আইএসের কারণেই। আর সেই আইএসের মাস্টারমাইন্ড, এবং সর্বময় কর্তা ছিলেন বাগদাদী।
ওসামা বিন লাদেন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টুইন টাওয়ার হামলায়। কিন্ত লাদেনের চেয়েও অনেক বেশি মানুষ মারার নির্দেশ এসেছে বাগদাদীর তরফ থেকে। নিয়মিত বিরতিতে ভিডিওবার্তা প্রদান করে আইএসের জঙ্গীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেন বাগদাদী, অথচ মার্কিন গোয়েন্দারা তার টিকির নাগালও পাচ্ছিলেন না, এতটাই গোপনীয়তা বজায় রেখে চলাফেরা করতেন বাগদাদী। গত দুই বছর ধরে আইএসের পতন ঘটছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে হঠিয়ে দেয়া হচ্ছে জঙ্গীদের, তবুও মাথা ঠান্ডা রেখে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে ধূর্ত এই জঙ্গীনেতা। অনেকের কাছেই বাগদাদী ছিলেন স্রেফ একটা মিথের মতো। একটা ক্যারেক্টার, যাকে ফ্রন্টলাইনে এনে আইএস নিজেদের প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্ত সেসবে জিহাদী মানসিকতা পোষণ করে ঘুরে বেড়ানো অপদার্থ লোকজনের মধ্যে বাগদাদীর জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। চাইলে 'জোকার' চরিত্রের সাথেও বাগদাদীকে মেলানো যাবে। জীবনভর যাকে কেউ পাত্তা দেয়নি, কোথাও নোটিশ করেনি, সেরকম একটা লোকই শেষমেশ পুরো দুনিয়ার ত্রাস হয়ে উঠেছে, মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় এক নম্বরে উঠে এসেছে!
১৯৭১ সালে ইরাকের ছোট্ট এক শহর সামারায় জন্ম বাগদাদীর। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ইব্রাহিম আল বদরী। ভীষণ ধর্মভীরু পরিবারে বেড়ে উঠেছেন, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য্য ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তবে সেটা যে জঙ্গীবাদে রূপ নেবে কখনও, এমনটা বোঝা যায়নি তখন। ইরাকের বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন, ভীষণ আগ্রহ ছিল কোরআন ও ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে। কোরআন স্টাডিজে ডক্টরেট ডিগ্রিও আছে তাঁর। দারুণ ফুটবল খেলতেন, তাঁর ব্যাচের সহপাঠীরা এখনও বলেন, তাদের মধ্যে সেরা ফুটবলার ছিলেন বাগদাদীই!
সেই তরুণ কীভাবে জঙ্গী হয়ে উঠলেন? কী করে তাঁর হাতে লেগে গেল হাজারো নিরপরাধ মানুষের রক্ত? কীভাবে তিনি হয়ে গেলেন পুরো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার নাম?
না, এর পেছনে সিনেমার মতো কোনো ট্র্যাজিক গল্প নেই। জেনেশুনে স্বেচ্ছায়ই এই ঘৃণার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়েই মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন বাগদাদী। ২০০০ সাল নাগাদ সালাফি জিহাদিদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের খবর অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যেই আফগানিস্তানে জিহাদি প্রশিক্ষণ নেন বাগদাদী। ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী যখন ইরাকে অভিযান শুরু করে, তখন বাগদাদী পুরোদস্তুর জঙ্গি। ইরাকীদের সঙ্গে তিনিও অংশ মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে। ২০০৪ সালে তাকে প্রথম এবং শেষবারের জন্য গ্রেফতার করেছিল মার্কিন বাহিনী। গ্রেফতারের পর বাগদাদীকে পাঠানো হয় বুক্কা ব্যাম্পে, সেখানে প্রায় ১০ মাস বন্দী জীবন কাটান বাগদাদী।
জেলে খুব কম কথা বলতেন বাগদাদী। বন্দি থাকাকালীন বেশিরভাগ সময়েই ধর্মীয় চর্চাই চালিয়ে যেতেন তিনি। সেখানে বিভিন্ন বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির নেতাদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ঘটে, বন্দী শিবির থেকে বেরিয়ে কী করবেন, সেই পরিকল্পনাটাও তখনই করে ফেলেছিলেন বাগদাদী। বাগদাদীর ঘনিষ্ঠ যারা, তাদের প্রায় সবাই একটা কথা বলেছেন- এই লোকের আকর্ষণী ক্ষমতাটা দুর্দান্ত। নিজের কথা দিয়েই যে কাউকে পটিয়ে ফেলতে পারতেন বাগদাদী। এই ব্যাপারটাই তাকে নেতৃত্বের আসনে উঠে আসতে সাহায্য করেছে খুব বেশি। জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো কখনোই শৃঙখলাবদ্ধ ছিল না, বিরোধী গোষ্ঠীগুলিকে এক জায়গায় আনার ক্ষমতা, ধর্মীয় পড়াশোনা এই সমস্ত কিছুই বাগদাদীকে নেতা হিসাবে উঠে আসতে দারুণ সাহায্য করেছিল।
বাগদাদীর কথাতেই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছিল সাদ্দাম হুসেনের বাথ পার্টির একাধিক সদস্য এবং ইরাকি সরকারের সেনাকর্তাদের অনেকে। জঙ্গী সংগঠনের নাম দেয়া হয় ইসলামিক স্টেট। যদিও তখনও সেটা কুখ্যাত হয়নি, কারণ দুনিয়াব্যাপী তখন জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে লাদেনের আল কায়দা-ই শীর্ষে। ২০১১ সালে লাদেন নিহত হলেন, এরপরেই আল কায়েদাকে ছাপিয়ে ইসলামিক স্টেটের ওপরের দিকে ওঠা শুরু।
সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল আল কায়েদা। কিন্তু, তার বদলে নিজের ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলাটাই প্রথম পছন্দ ছিল বাগদাদীর। কঠোর ধর্মীয় আইন-কানুন নিয়ে শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। মতের পার্থক্য হওয়ায় আইএস-কে জঙ্গি সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে আল কায়দা। তবে তাতে শাপে বর হয় বাগদাদীর। আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর পরই, ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিতে শুরু করে আইএস জঙ্গিরা। এদের বিশেষত্ব ছিল, এই জঙ্গীরা যে কোনো মূল্যে বাগদাদীর কথা মানতে রাজী, তাতে জীবন গেলেও যাক। একেকজন হয়ে উঠেছিল সুইসাইড সেল, বাগদাদীর আদেশই তাদের কাছে শেষ কথা।
এভাবেই ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল চলে আসে আইএসের দখলে। মসুল দখলে আসার পরপরই নিজেকে ‘খলিফা’ হিসাবে ঘোষণা করে বাগদাদী। শুরু থেকেই একের পর এক নৃশংসতার নজির তৈরি করেছে আইএস। কোনো একটা শহর দখলের পর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্মমভাবে অত্যাচারের কোনো নিদর্শনই বাদ রাখেনি তারা। ইয়েজিদি সহ অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে আইএসের অত্যাচারের নজির দেখে শিউরে উঠেছে গোটা বিশ্ব।
বিদেশী নাগরিক বা সাংবাদিকদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে শিরচ্ছেদ করা আর সেগুলোর ভিডিও আপলোড করা তো ছিল নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা। ত্রাসের সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন বাগদাদী, সেই কাজে যে তিনি পুরোপুরি সফল হয়েছেন, সেটা বলতেই হচ্ছে। গুলশানের হোলি আর্টিজানের হামলার পেছনেও আইএসের হাত ছিল বলে দাবী করেছে তারা, কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িতরা আইএসের কর্মী ছিল বলে প্রমাণও দিয়েছে তারা। তখন থেকেই আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে তার নামটা সবার ওপরে ঠাঁই পেয়েছে। বাগদাদীকে খুঁজে বের করার অজস্র চেষ্টা করেছে আমেরিকা, তার মাথার দাম ধরা হয়েছে আড়াই কোটি ডলার।
২০১৬ সালে অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বাগদাদী। ইরাকের মসুলে আইএস বাহিনীর সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই চলছিল তখন। শহরের বাইরের কোনো এক জায়গা থেকে আল-বাগদাদী এক রেডিও বার্তার মাধ্যমে তার অনুসারীদের লড়াই চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেন। সেই বার্তাটি জোট বাহিনী পরিচালিত একটি গোয়েন্দা বিমানের রাডারে ধরা পড়ে গিয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালিয়েও বাগদাদীকে সেখানে পাওয়া যায়নি, এর আগেই সরে গিয়েছিলেন ধূর্ত এই জঙ্গী নেতা। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বাগদাদী ভীষণ সচেতন ছিলেন, কারণ তার জানা ছিল, বাগদাদী শেষ মানে আইএসও শেষ। বিন লাদেনের মতো বোকামী করে ধরা পড়ার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না, প্রযুক্তি সম্পর্কেও দারুণ ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি।
হাজার হাজার মানুষের রক্ত লেগে থাকা এই ঘৃণ্য নরপিশাচটার জীবনের ইতি ঘটে গেছে গত বছর। উত্তর পশ্চিম সিরিয়াতে মার্কিন সেনাদের অভিযানের মুখে গায়ে থাকা সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করেছে এই জঙ্গী নেতা। বাগদাদীর শেষটা তো হয়ে গেল, আইএসের মূলোৎপাটন কবে নাগাদ হয়, এটাই এখন দেখার বিষয়..