কারাগারের ভেতরে মই বানিয়ে, সেই মই কাঁধে নিয়ে সবার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে গেল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক আসামী! ওই কয়েদি আগেও পালানোর চেষ্টা করেছে, কয়েদির পোশাকও কখনও গায়ে দিত না সে- তবুও কারা কর্তৃপক্ষ তার ওপর বাড়তি নজরদারীর কথা ভাবেনি...

চ্যাপো গুজম্যানের নাম আপনারা শুনেছেন কিনা জানিনা। ভয়ংকর এক মাদক পাচারকারী ছিল এই লোক, কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হয়েছিল পুলিশের হাতে। কিন্ত তাকে আটকে রাখাটা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। জেল পালানোটা তার কাছে ছিল ডাল-ভাত টাইপের কাজ। মেক্সিকোর আলতিপ্লানো ফেডারেল প্রিজন কারাগারটাকে ধরা হয় বন্দীদের জন্যে দুর্ভেদ্য এক দূর্গ, এখান থেকে পালানোর নেই কোন উপায়। সেই জেলখানা থেকে আঠারো জন নিরাপত্তারক্ষীকে ফাঁকি দিয়ে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন গুজম্যান, অবিশ্বাস্য এই ঘটনাটা নিয়ে হলিউডে সিনেমাও বানানো হয়েছে। 

ভালো কাজ তো আমাদেরকে দিয়ে হয় খুব কম, তবে খারাপ কাজের অনুকরণে বরাবরই আমরা পারদর্শী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চ্যাপো গুজম্যানের যোগ্য উত্তরসূরীর দেখা বাংলাদেশ পেয়ে গেছে। নাম তার আবু বকর ছিদ্দিক। খুনের মামলায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিল এই আসামি, পরে আপিল করায় সেই সাজা নেমে আসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে। সেই আসামিই কিনা নিজে মই বানিয়ে, সেই মই বেয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে গেছেন কাশিমপুরের দুই নম্বর কারাগার থেকে, যে কারাগারটাকে 'হাই সিকিউরিটি প্রিজন সেল' হিসেবে ধরা হয় আমাদের দেশে! 

আবু বকর ছিদ্দিকের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা ঘটে গত ৬ই আগস্ট। অথচ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বন্দী পালানোর ঘটনা জানানো হয়েছে দীর্ঘ ষোলো ঘন্টা পরে, সেটাও আবার জানানো হয়েছে ই-মেইল মারফত! ততক্ষণে আবু বকর ছিদ্দিক নিশ্চয়ই নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে। পুরো ঘটনাটা এত জঘন্য রকমের ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঠাসা যে, কারো মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ভেতরের কেউ সাহায্য না করলে আসামি আবু বকর এভাবে পালিয়ে গেলো কি করে? 

২০১১ সালে মৃত্যুদণ্ডের আসামি হিসেবে রাজশাহী কারাগার থেকে কাশিমপুর-২ কারাগারে আনা হয় আবু বকর ছিদ্দিককে। ২০১২ সালের ২৭শে জুলাই আদালত তার সাজা সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেই থেকে এই আসামি কাশিমপুরেই ছিল। এরমধ্যে একাধিকবার সে পালানোর চেষ্টা করেছে, ২০১৫ সালে তো একবার কয়েক ঘন্টার জন্য নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল সে। বন্দীর সংখ্যা না মেলায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরে দেখা যায়, সেল এরিয়াতে সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে লুকিয়ে আছে আবু বকর! 

কারাগারে আবু বকর ছিদ্দিকের সঙ্গে থাকা বন্দীরা জানিয়েছেন, এই লোক কথাবার্তা তেমন বলতো না, চুপচাপ থাকতো, কারো সাথে মিশতোও না। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের সর্বক্ষণ কয়েদির পোশাক পরার নিয়ম থাকলেও, আবু বকর কখনও সেই নিয়ম মানতো না বলেও জানিয়েছে অন্য কয়েদিরা। সে সবসময়ই সাধারণ জামা-কাপড়ে থাকতো, এমনকি পালানোর দিনও তার গায়ে কয়েদির পোশাক ছিল না! 

গত ৬ আগস্ট বেলা সোয়া ১১টায় কাঁধে একটা মই নিয়ে সাধারণ পোশাকে কাশিমপুর কারাগারের ব্রহ্মপুত্র ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে বের হয় আবু বকর। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, এসময় তার আশেপাশে নিরাপত্তারক্ষীরা ছিল, কিন্ত এত বড় মই নিয়ে সে কোথায় যাচ্ছে, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি, কেউ তাকে কোন প্রশ্নও করেনি। ছিদ্দিক মইটি কাঁধে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র ভবনের বাইরের ফটক দিয়ে বেরিয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে কারাগারের মূল ফটকের দিকে গিয়েছিল। মূল ফটকে দায়িত্বরত কারারক্ষীও তাকে আটকায়নি। দুপুর সাড়ে বারোটার সামান্য আগে সীমানা প্রাচীরের পাশে মইটি পড়ে থাকতে দেখে একজন কারারক্ষী রিপোর্ট করে। 

কাশিমপুরের এই কারাগার থেকেই পালিয়েছে আসামি আবু বকর ছিদ্দিক

এরপরে শুরু হয় বিলম্ব বিলম্ব খেলা। কারারক্ষী থেকে শুরু করে জেল সুপার- সবাই বন্দী পালানোর ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে দেরি করেছেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনে আমরা দেখতে পাই, সর্বপ্রধান রক্ষী আবুল কালাম আজাদ, গোয়েন্দা সহকারী প্রধান রক্ষী আহাম্মদ আলী, গোয়েন্দা কারারক্ষী হক মিয়া কেউই মইটি এভাবে রাখাসহ বন্দীর পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কিছুই জানাননি। একজন কয়েদি কম থাকায় দুপুরে গণনায় তা ধরা পড়লেও সর্বপ্রধান কারারক্ষী বিষয়টি জেলার বা জেল সুপারকে জানাননি। সন্ধ্যায় তালা বন্ধ করার সময় গণনায় একজন বন্দী কম পড়লে তখন বিষয়টি ডেপুটি জেলার ও জেলার জানতে পারেন। আর গাজীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘটনা সম্পর্কে জানানো হয় পরদিন।

পুরো ঘটনাটা শুনলে যে কারো মনে শত শত প্রশ্নের জন্ম হবে, যে প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। জেলের ভেতর বসে বসে একজন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি কিভাবে এত লম্বা মই তৈরি করলেন? সেটা নিরাপত্তারক্ষীদের কারো চোখে পড়লো না? আবু বকর ছিদ্দিক যে কয়েদির পোশাক না পরেই বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, সেটাও কারো নজরে এলো না? একবার নিখোঁজ হওয়ার নজির থাকা, অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে অন্য বন্দীদের থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা এবং কয়েদি পোশাক না পরিধানের অভ্যাস থাকলেও কারা কর্তৃপক্ষ তার ব্যাপারে নজরদারি বা তাকে কয়েদি পোশাক পরতে বাধ্য করার জন্য কোনো পদক্ষেপ কেন নেয়নি? 

ঘটনার দিন কারাগারের ৪৮টি সিসিটিভি ক্যামেরার মধ্যে ২৭টি অচল ছিল, সার্চ লাইটও ছিল অকেজো। কেন জেলখানার মতো একটা সেনসেটিভ জায়গায় সিংহভাগ সিসিটিভি ক্যামেরা অকেজো থাকবে? দেশের সবচেয়ে হাই সিকউরিটি কারাগারের নিরাপত্তার যদি এই দশা হয়, তাহলে গোটা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। আবু বকর মই কাঁধে নিয়ে সেল থেকে বের হলো, সবার নাকের ডগা দিয়ে সীমানা প্রাচীরের দিকে গেল, প্রাচীর টপকে পালিয়েও গেল- কারো মাথায় এই প্রশ্ন এলো না যে একজন কয়েদি মই নিয়ে কেন যাচ্ছে? বন্দী পালানোর ঘটনাটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানো হয়েছে ১৬ ঘণ্টা পর- কেন এই বিলম্ব? এতসব প্রশ্নের জবাব কে দেবে? 

আবু বকর ছিদ্দিকের এভাবে সবার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাওয়াটাই প্রমাণ করে, দেশটা ধীরে ধীরে অপরাধীদের জন্য স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে, এখানে জঘন্য অপরাধ করেও কয়েক বছর জেল খেটে পালানো যায়। ঘটনার পর প্রায় বিশ দিন কেটে গেলেও এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি তাকে। পুলিশের কাছেও কোন হদিশ নেই, কোথায় সে থাকতে পারে। আসামি পালানোর ষোলো ঘন্টা পরে রিপোর্ট করা হলে তার ট্রেস খুঁজে বের করা কি আর এত সহজ হয়! 

মেক্সিকোর চ্যাপো গুজম্যানের পালানোর ঘটনায় জেলখানার ভেতরের লোক জড়িত ছিল, সেটা পরে প্রমাণীত হয়েছে, এই ড্রাগলর্ডের কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাকে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে সাহায্য করেছিল নিরাপত্তারক্ষীদেরই কেউ কেউ। কাশিমপুর থেকে আবু বকর ছিদ্দিকের পালানোর ঘটনায় ভেতরের কেউ জড়িত কিনা, সেটা খুঁজে বের করা ভীষণ দরকার। সর্ষের মধ্যে ভূত নিয়ে আর যাই হোক, খুন-ধর্ষণের আসামি সামলানো যায় না...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা