স্বপ্নের সমান বড় একজন আলোকিত মানুষের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করতেন, তাঁর ক্লাস উপচে পড়তো ছাত্রদের ভীড়ে। অন্যান্য ক্লাসের ছেলেরাও ভীড় জমাতো তাঁর কথা শোনার জন্যে। বাংলাদেশের খুব অল্প কিছু মানুষের একজন তিনি, যাকে নিয়ে দলমত নির্বিশেষে গর্ব করা যায়...
বাবা ছিলেন মুন্সীগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেছেন সবেমাত্র। বছর বাইশের টগবগে তরুণ শিক্ষকতার জন্য আবেদন করলেন একই কলেজে। গভর্নিং বডির সভায় নেয়া হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কিন্ত ছেলে এই কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দিলে প্রশাসনিকভাবে অস্বস্তির কারণ হবে ভেবে তাঁর নিয়োগে বেঁকে বসলেন বাবা, জানালেন আপত্তি। কিন্ত শিক্ষাজীবনের ফলাফল ভালো থাকায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তাঁকে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিলো গভর্নিং বডি।
নিয়ম অনুযায়ী নতুন শিক্ষককে ছাত্রদের সামনে পরিচয় করাতে নিয়ে গেলেন অধ্যক্ষ পিতা, বাবার পেছনে পেছনে মাথা নীচু করে ঢুকলো ছেলে। সবার সামনে গর্বিত পিতা পরিচয় করিয়ে দিলেন শিক্ষক ছেলেকে, বললেন- “যেহেতু ওর শরীরে শিক্ষকের রক্ত আছে আমার মনে হয় ও ভাল শিক্ষকই হবে।” গলাটা ধরে এলো মানুষটার। ছেলে তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে! বাবার কথা রেখেছিল ছেলে, ভালো একজন শিক্ষক নন শুধু, তিনি হয়ে উঠেছেন মশাল হাতে আলোকবর্তিকা। শিক্ষার আলো প্রচারের পাশাপাশি লক্ষ তরুণকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন যিনি, তিনি বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
কলকাতার পার্ক সার্কাসে তাঁর জন্ম, পৈত্রিক নিবাস ছিল বাগেরহাটে। পিতা আজীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন স্বনামধন্য শিক্ষক। শিক্ষক পিতাই ছিলেন তাঁর জীবনের আদর্শ, আর তাই জ্ঞানের আলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার বাসনাটাই হয়ে উঠেছিল জীবনের ব্রত। বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, সেখান থেকেই সম্পন্ন করলেন অনার্স-মাস্টার্স। এরপর শিক্ষক হিসেবে মুন্সীগঞ্জ কলেজে যোগদানের কথা তো বলা হলোই।
তবে মুন্সীগঞ্জে বেশীদিন ছিলেন না, চলে গেলেন সিলেট মহিলা কলেজে, সেখানে ছিলেন মাত্র দুই মাস, ১৯৬২ সালের এপ্রিলে রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্যে দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় থিতু হলেন। রাজশাহী থেকে বদলী হয়ে এলেন ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে(বর্তমান সরকারী বিজ্ঞান কলেজ)। এখানে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে, বয়স তখন পঁচিশও ছোঁয়নি তাঁর! দুবছর সেখানে চাকুরী করেছিলেন তিনি। এরমধ্যে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদ অনেকটা জোর করেই তাঁকে নিয়ে গেলেন নিজের কলেজে, দেশের অন্যতম সেরা এই কলেজ ধন্য হলো তাঁর মেধার স্পর্শে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবনটা তাঁর কাছে ছিল দারুণ উপভোগ্য, একই সময়ে ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন ঔপন্যাসিক শওকত ওসমানও, তাঁর সাহচর্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে করেছিল অনেকাংশে সমৃদ্ধ। টাকা পয়সা বা বিত্ত বৈভবের প্রতি মোহ তাঁর কোনকালেই ছিল না, তাঁর মোহ ছিল একটি বিষয়েই, জ্ঞান আহরণ আর সেটাকে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়ায়। সেই কাজটাই করে চলেছেন এখনও, একাশি বছর বয়সেও।
ক্লাসে কখনও রোলকল করতেন না তিনি, বলতেন- “অনিচ্ছুক হৃদয়কে ক্লাশে জোর করে বসিয়ে রেখে কী করব? আমার চ্যালেঞ্জ ছিল এক ধাপ বেশি: কেবল শিক্ষক হওয়া নয়, সব ছাত্রের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানো, সব ছাত্রের হৃদয়কে আপ্লুত করা।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ভালোবাসার জায়গাটিকে ছেড়ে যেতে চাননি বলেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা জ্ঞানপীঠ, মেধাবীদের আনাগোনা সেখানে। কিন্ত তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন তুলনামূলক কম মেধাসম্পন্ন ছাত্রদের নিয়ে, তাদের আলোকিত করতে চেয়েছেন নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে। তিনি বলেছিলেন-
“বাংলা বিভাগে যোগদান করাটা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো ছাত্রদের ছেড়ে সবচেয়ে খারাপ ছাত্রদের পড়াতে যাওয়ার মত মনে হয়েছে।”
আর এই তথাকথিত খারাপ ছাত্রদের তিনি সারাটা জীবন পড়িয়েছেন সবটুকু মমতা আর ভালোবাসা দিয়েই। কিন্ত একটি প্রতিষ্ঠান বা কয়েক হাজার ছাত্র নয়, তিনি চেয়েছিলেন সারা বাংলাদেশের সব বয়সের মানুষ বই পড়বে, অজানাকে জানবে, অশিক্ষার অন্ধকার দূর হয়ে দেশ উদ্ভাসিত হবে সুশিক্ষার আলোয়। সেই ভাবনা থেকেই ১৯৭৮ সালে “আলোকিত মানুষ চাই” স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের।
মাত্র পঁচিশ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই পাঠচক্রের, ধীরে ধীরে সময় গড়িয়েছে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নামের এই জ্ঞানের ভাণ্ডার ছড়িয়েছে সারা দেশেই। বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে বই পড়ুয়াদের সংখ্যাও। বর্তমানে দেশের প্রায় সবগুলো জেলাতেই কার্যক্রম চালু আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের, আছেন স্বেচ্ছাসেবক কর্মীও। ১৯৯৮ সাল থেকে মানুষের হাতের নাগালে বই পৌঁছে দিতে নরওয়ের সরকারের সহযোগীতায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইভর্তি গাড়ির ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী ছুটেছে শহর থেকে শহরে। কিশোর থেকে তরুণ প্রজন্মকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য, সেই সঙ্গে অনস্বীকার্য এসবের পেছনে থাকা মানুষটার অবদানও।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একুশে পুরষ্কার, বাংলা একাডেমী পুরষ্কার। এশিয়ার নোবেলখ্যাত ‘র্যামন ম্যাগসেসে’ পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন ২০০৪ সালে। শুধু শিক্ষাবিস্তার নয়, সমাজ সংস্কারেও ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন’ করেছেন তিনি, পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকদিন ধরেই। ঢাকায় যখন ডেঙ্গু মহামারী আকার নিয়েছে, তিনি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে নেমেছেন রাস্তায়, মানুষকে সচেতন করেছেন, প্রচার করেছেন ডেঙ্গু মোকাবেলায় করণীয়। স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করেছেন, নিজের হাতে রাস্তাঘাটের ময়লা পরিষ্কার করেছেন, ডেঙ্গুর আবাসস্থল খুঁজে ধ্বংস করেছেন সবাইকে নিয়ে।
যেখানেই গিয়েছেন, নিজের অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দারুণভাবে। টেলিভিশনে ১৯৬৪ সালে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন মুস্তফা মনোয়ার, কবি জসিমউদ্দিনের সাক্ষাৎকার নিয়ে শুরু হয়েছিল টিভি পর্দায় তাঁর পথচলা। স্বাধীনতার পরে ‘স্বপ্তবর্ণ’ নামের অনুষ্ঠান করে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ষাটের দশকে সাহত্য আন্দোলনে রেখেছিলেন ভূমিকা, তিনি তখন সবে চাকুরীজীবনে প্রবেশ করেছেন। ঢাকা কলেজে যখন শিক্ষকতা করতেন, তাঁর ক্লাস উপচে পড়তো ছাত্রদের ভীড়ে। অন্যান্য ক্লাস বা অন্যবর্ষের ছেলেরাও ভীড় জমাতো তাঁর কথা শোনার জন্যে। স্মিত হাসির এই মানুষটার বক্তৃতা শোনার জন্যে উপচে পড়া ভীড় হয় এখনও।
১৯৩৯ সালের আজকের এই দিনে জন্মেছিলেন বাংলাদেশের এই সূর্যসন্তান, খুব অল্প কিছু মানুষের মধ্যে একজন তিনি, যাকে নিয়ে দলমত নির্বিশেষে আমরা গর্ব করতে পারি। শিক্ষার আলোয় নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজ করে চলেছেন যিনি নিরলসভাবে, স্বার্থহীনভাবে। শুভ জন্মদিন জ্ঞানের ফেরিওয়ালা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।