সত্তর টাকা পকেটে নিয়ে মানুষটা ঢাকা শহরে পা রেখেছিলেন। যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, তার অনেক আগে থেকেই তিনি দেশের শীর্ষ শিল্পপতিদের একজন, দশ হাজার মানুষ চাকরি করে তার প্রতিষ্ঠানে...

এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে আত্মীয়স্বজন আর ময়মুরুব্বিদের দোয়া নিতে গিয়েছিলেন তিনি। কেউ কেউ তখন হাতে পাঁচ-দশ টাকা করে গুঁজে দিয়েছিলেন। মোট সত্তর টাকা জমেছিল পকেটে। সেই সত্তরটা টাকা সম্বল নিয়ে তিনি পরীক্ষার পরে ঢাকায় এসেছিলেন, জাদুর শহর, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে। তারপর কত জল গড়িয়ে গেল পদ্মা-মেঘনা-যমুনায়। গত বছরের ৩১শে মে যখন শেষ নিঃশ্বাসটা ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেন মানুষটা, তখন তিনি দেশের সেরা শিল্পপতিদের একজন, বিজনেস টাইকুন, কেউবা আবার তাকে ডাকে 'নির্মাণ জগতের মোঘল সম্রাট' নামে! তিনি আবদুল মোনেম, বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পগোষ্ঠী আবদুল মোনেম লিমিটেডের (এএমএল) প্রতিষ্ঠাতা। 

শুরুটা যেভাবে

আবদুল মোমেনের জন্ম অবিভক্ত ভারতের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজেশ্বরে। সততা আর কাজের প্রতি নিষ্ঠা- ওই দুটো জিনিস খুব অল্প বয়স থেকেই তার সঙ্গী। এইচএসসি পাশ করে ঢাকায় আসার পরে চাকরি নিয়েছিলেন একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে, সেকশন অফিসার হিসেবে। পরে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই কিছু করার কথা ভাবলেন। ব্যবসার এই ক্ষেত্রটা সম্পর্কে যেহেতু জানাশোনা ছিল, তাই শুরু করলেন নির্মাণ ব্যবসা। ১৯৫৬ সালে জন্ম নিলো আবদুল মোনেম এএমএল সিভিল কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।

মিঃ হাইজিন- জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রতিমূর্তি

ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা অথবা একজন মানুষ  হিসেবে কাজের বেলায় আবদুল মোনেম একটা জিনিসই ভাবতেন, জীবনে যা-ই করি না কেন, সেরাটাই করব, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করব। যাদের সততা ও নিষ্ঠা নেই, তারা সফল হতে পারে না। পণ্যের নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা এবং যথাসময়ে সরবরাহ করতে পারায় শুরু থেকেই সুনাম অর্জন করে কোম্পানিটি। একদম শুরুর দিনগুলোতে তার ব্যবসার কোনো চলতি মূলধন ছিল না। ছিল শুধু বাজারের সেরা পণ্যটা সরবরাহ দেয়ার স্বপ্ন, বাকীদের চেয়ে এক।কদম এগিয়ে থাকার প্রত্যয়। সেইসঙ্গে সততা ও নিষ্ঠাই তাকে মূলধনের সংকট উতরে যেতে সাহায্য করেছে। বিনিয়োগকারীরা তার ওপর ভরসা রেখেছেন, তাদের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন আবদুল মোনেম।

এগিয়ে চলার গল্প

আবদুল মোনেমের সেই সততা আর নিষ্ঠার ফর্মূলা ধরেই এগিয়ে গিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। ৬৪ বছর আগে জন্ম নেয়া আবদুল মোনেম গ্রুপ গত কয়েক দশক ধরেই দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজে সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছে গ্রুপটি। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, বিভিন্ন সেতু নির্মাণ, জয়দেবপুর-এলেঙ্গা মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণসহ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে পথপ্রদর্শক ছিলেন এই মানুষটা। 

দেশের জন্যে আবদুল মোনেমের যা অবদান

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িয়ে আছে আবদুল মোনেম গ্রুপের নাম। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ, জয়দেবপুর-এলেঙ্গা মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে গ্রুপটি। এছাড়া, ৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে খুলনা-মোংলা হাইওয়ে নির্মাণ, ৪২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভাটিয়াপাড়া-গোপালগঞ্জ-মোল্লাহাট সড়ক, গড়াই সেতু, মাওনা সেতু, গুলশান-বনানী সেতু, বনানী ফ্লাইওভার, লালন সেতুর এপ্রোচ সড়কসহ অসংখ্য অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেছে আবদুল মোনেম কনস্ট্রাকশন। 

আবদুল মোনেম গ্রুপের বিশাল কর্মযজ্ঞ

দেশি কোম্পানি হিসেবে বাড়তি সুবিধা হিসেবে নয়, বরং আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা ঠিকাদারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে তারা। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে খুলনা-মোংলা হাইওয়ে প্রজেক্ট, পদ্মা বহুমুখী সেতু এপ্রোচ সড়ক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সার্ভিস এরিয়া-২ নির্মাণের কাজ পেয়েছেন আবদুল মোনেম। দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পপতিদের একজন হয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বা প্রতিপত্তির অপব্যবহার করেছেন কখনও- আবদুল মোনেমের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেউ তুলতে পারবে না কখনও। 

কেবল রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণই নয়, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন, ত্রিবেণী নামে পরিচিত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এসএম বারাক অ্যান্ড দামাল কোট নির্মাণ, গাবতলী, মহাখালী ও সায়দাবাস বাস টার্মিনাল নির্মাণ করেছে আবদুল মোনেম কনস্ট্রাকশন।

ধীরে ধীরে সময়ের সাথে তিনি ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করেছেন। ব্যবসার নতুন ক্ষেত্রও তৈরি করেছেন। কোকা-কোলা, ফানটা, স্প্রাইট, ইগলু চিনি, আইসক্রিম, ইগলু মিল্ক, ডেইরি, পরিবেশবান্ধব পাউরুটি, আর্থিক সেবা, আইটি সার্ভিস, এনার্জি- এসব প্রতিষ্ঠা করেছেন। পর্যায়ক্রমে এএমএল মাল্টি ডিসিপ্লিনারি বিজনেস গ্রুপে রূপ নেয়। বাংলাদেশে ইটের ব্যবসা অনেকেই করেছে, এখনও করছে। কিন্ত পরিবেশ আইন মেনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব ইট এদেশে প্রথম তৈরি হয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত এএম অটো ব্রিকসে। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি, সুগার রিফাইনারি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছেন। বারবার নিজেকেই নিজে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, সেই চ্যালেঞ্জ জয়ও করেছেন। 

ছিল না রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ

নির্মাণ খাতের মত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও তার ব্যবসায়িক মতাদর্শ কখনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়নি। সব দল, সব সরকারের সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিল, সব সরকারের আমলেই দেশের অন্য তিনি অবদান রেখেছেন, তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। ব্যবসা শুরু করার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়েছে, বারবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে, কিন্ত এসব কিছুই আবদুল মোনেমের ব্যবসায়িক মতাদর্শকে প্রভাবিত করতে পারেনি।

তাকে পুরস্কৃত করছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

বাংলাদেশে অনেক ব্যবসায়ীই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করে থাকেন। কিন্তু আবদুল মোনেম তার সততা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন যে তিনি কোনো রাজনৈতিক চাপে প্রভাবিত হবেন না। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক, আবদুল মোনেমের নৈতিক দৃঢ়তা ও ব্যবসায়িক সততার জন্য প্রত্যেকটা সরকার তাকে সম্মান দিয়েছে। তিনিও প্রতিটি সরকারের সময়েই ব্যবসা করে গেছেন। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবে আবদুল মোনেম তার ব্যবসার নীতির সাথে আপস করেননি। তার এই চারিত্রিক দৃঢ়তাকে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক চিন্তাধারা সম্মান করেছে। তিনি সৎভাবে ব্যবসা করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে ব্যবসা কতটা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। 

বয়স তাকে হার মানাতে পারেনি

আবদুল মোনেম মারা গেছেন ৮৩ বছর বয়সে। অথচ জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি নিয়মিত অফিস করতেন। নিতান্ত অসুস্থ না হলে অফিস কামাই করতেন না। নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন, বয়স, বার্ধক্য বা শারীরিক অসুস্থতা- কোনকিছুই তাকে পরমুখাপেক্ষী বানাতে পারেনি। একটা অনুষ্ঠানে তাকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানীত করা হয়েছিল। সেখানে তিনি বলেছিলেন- 'আমাকে শুধু বিদ্যুৎ আর গ্যাস দিন, আর কিছু লাগবে না, যা নির্মাণ করা লাগবে তা আমরা করে নিতে পারবো' - নিজের সততা ও কর্মদক্ষতার ওপর এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল তার! 

আমাদের দেশের প্রচুর তরুণ-তরুণী উদ্যোক্তা হতে চায়, তাদের মাথাভর্তি আইডিয়া। তবুও তাদের অনেকে সফল হতে পারে না, দিনশেষে তারা দেশের সিস্টেমকে গালি দেয়। এই সিস্টেমেই সত্তর টাকা পকেটে নিয়ে একজন মানুষ আবদুল মোনেম হয়েছিলেন, দশ হাজার কর্মচারী এখন তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তিনি প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় অচেনা অজানা ঢাকা শহরে এসেছিলেন, চাকরি ছেড়ে ব্যবসার পথে হেঁটেছিলেন। বারবার তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন, নতুন নতুন ব্যবসায় হাত দিয়েছেন। নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই সাহসটার বড্ড অভাব, সেজন্যেই হয়তো আর কোন আবদুল মোনেমের জন্ম হচ্ছে না এদেশে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা