দিন যত যাচ্ছে, নিজেকে তত হারিয়ে ফেলছেন? চেক করে নিন এই ৮টি অভ্যাস, যেগুলোর কারণে নিজ অজান্তেই দিনদিন অসুখী হয়ে উঠছেন আপনি!
'সবাই তো সুখী হতে চায়
কেউ হয়, কেউ হয় না'
কথাগুলো শুধু গানেই, বাস্তবতা ভিন্ন। সুখ আসলে তারই, যে সুখী হতে চায়। অর্থাৎ, আপনি সুখী হবেন কি না, তা অনেকাংশে আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। অনেকে ভাবেন টাকা থাকলেই হয়তো সুখী হওয়া যায়। কিন্তু টাকার অভাব কখনো অসুখী হওয়ার অন্তরায় না। আপনি চাইলে কম টাকা উপার্জন করেও জীবনে সুখী হতে পারেন, নির্ভর করছে- আপনি চাইছেন কিনা, তার উপর!
তাহলে কোন বিষয়টি আসলে আপনাকে দিন দিন অসুখী করে তুলছে? কেন দিন যত যাচ্ছে, আপনি নিজেকে তত হারিয়ে ফেলছেন? উত্তরটি হলো- আপনার অভ্যাসে কারণে। অভ্যাস না বলে বদভ্যাস বলাই ভাল, যেগুলো দিন দিন শুষে নিচ্ছে আপনার সুখ। আপনি হয়তো বুঝতেও পারছেন না, হতাশার চাদরে নিমগ্নিত হচ্ছেন দিন দিন।
ব্রাইটসাইড অবলম্বনে এরকম ৮টি বদভ্যাসের কথা নিচে দেওয়া হলো, যেগুলো মানুষের সুখ কেড়ে নিয়ে তাঁদের অসুখী করে তোলে। চেক করে নিন এর মধ্যে কোন কোন অভ্যাসগুলো আপনার মধ্যে আছে, যার কারণে নিজ অজান্তেই দিনদিন অসুখী হয়ে উঠছেন আপনি!
১. অনুভূতিকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা
ভাল সময় খারাপ সময় মিলিয়েই মানুষের জীবন। ভাল সময়ে যেমন আনদের বহিপ্রকাশ ঘটে, খারাপ সময়েও খারাপ অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে হয়। অনেক সময় আমাদের বলা হয়, নিজের কষ্টগুলো কারো সাথে শেয়ার করা উচিত না। কিন্তু আপনার সুখ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য এই অভ্যাসটা অনেকাংশে দায়ী। কষ্ট বোধ করলে চেপে না রেখে শেয়ার করুন। কান্না পেলে কাঁদুন। কান্না চাপিয়ে রাখার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। দেখবেন, কারো সাথে শেয়ার করলে বা কাঁদলে হালকা হয়ে গেছেন অনেক এবং এরপর অনেক সমীকরণ মিলানো হয়তো সহজ হয়ে যাবে।
২. নিজের ভুল সহজভাবে গ্রহণ করতে না পারা
আমরা মানুষ, ভুল-ত্রুটি হওয়া আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। সবসময় যে বিষয়গুলো ঘৃণা করে এসেছেন, কখনো ভাবতেও পারেননি আপনি করতে পারেন- এরকম কোনো কাজ হয়তো আপনি করে বসলেন। একটা সময় পর আপনার মনে হলো কাজটি করা আপনার উচিত হয়নি, এবং সে মুহূর্ত থেকে অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আপনাকে। আপনি হয়ে যাচ্ছেন বিমর্ষ, দুঃখী।
অথচ আপনার করণীয় হওয়া উচিত- যে মুহূর্তে আপনার বোধদয় হলো যে কাজটি আপনি ঠিক করেননি, ঠিক সে মূহুর্তে তা গ্রহণ করে নিজেকে ক্ষমা করে দেওয়া। নিজেকে ক্ষমা করার অর্থ কোনোভাবেই আত্মপক্ষ সমর্থন করা না। অর্থাৎ, আপনি দোষ করেছেন, সে ব্যাপারটি মেনে নিয়ে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং একই ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে কোনোভাবেই না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। এই গুণটি যদি না থেকে থাকে আপনার, তবে জেনে রাখুন- আপনার অসুখী হবার জন্য এটি একটি মূল কারণ!
৩. ভিক্টিম হয়ে থাকতে পছন্দ করা
ক্লাসে বা অফিসে যেতে দেরি হয়েছে? রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল! মাসের শেষে হাত খালি, শখের একটি জিনিস কিনতে পারছি না? তারা আসলে বেতনই দেয় কম! এরকম অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে, যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু সত্যিটা হলো- নিজের সমস্যার জন্য অন্য ব্যক্তিকে কিংবা কোনো অবস্থাকে দায়ী করা অসুখী হবার আরেকটি প্রধান কারণ।
কেউ সফল হলে আমরা বলি তার অমুক সুবিধা ছিল, তমুক তাকে অনেক সাহায্য করেছে ইত্যাদি। আর কারো খারাপ কোনো কিছু শুনলেই এই লোকটি অমুক খারাপ কাজটি করেছে বলে ফেলি। অর্থাৎ ভালো কাজে ব্যক্তির অবস্থার কৃতিত্ব দেই, আর খারাপ কাজে ব্যক্তির নিজের দোষ দেই। এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেদের ভিক্টিম ভাবা বন্ধ করতে হবে। নিজেদের সফলতা বা ব্যর্থতার দায়ভার একান্তই নিজের, কোনো অবস্থা বা অন্য কোনো ব্যক্তি নয়।
৪. রাগ-অভিমান পুষে রাখা
রাগ-অভিমান পুষে রাখলে ডিপ্রেশন থেকে শুরু করে হার্টের রোগ পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। আর এ কথা তো সবারই জানা যে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। অর্থাৎ রাগ-অভিমান আপনার অসুখী হবার একটি কারণ। স্বাস্থের কথা বাদ দিলেও রাগ অভিমান পুষে রাখলে বারবার রাগের কারণটি আপনার মনে পরবে এবং যতবার মনে পরবে, ততবারই আপনি বিরক্ত হবেন নিজের উপর, যে ব্যক্তির উপর রাগ করেছেন তার উপর। এই বিরক্ত বোধ করায় নিজেকে নিজে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না। তাই কারো উপর রাগ-অভিমান হলে চেপে না রেখে প্রকাশ করে ফেলুন।
৫. নিজেকে মাইন্ড রিডার ভাবা
আপনি যদি অতিমানব না হয়ে থাকেন, তবে অন্যরা কী ভাবছে তা জানা আপনার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অথচ বাস্তবে আমরা নিজেদের অতিমানব ভেবে বসি এবং অন্যরা আমাদের নিয়ে কী ভাবছে, তা ভেবে আমরা দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। অসুখী হতে এই ভাবনা একটি বড় সহায়ক। অন্যরা কী ভাবছে এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে আপনি আপনার আত্মবিশ্বাসকে তলানিতে ফেলে দিচ্ছেন, আর দিনকে দিন নিজেকে হারিয়ে ফেলে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
এ বিষয়ে একটি কথা মজা করে বলা হয়- অন্যরা কী ভাবছে তা নিয়ে যদি আমরা ভাবি, তবে অন্যরা ভাববে কখন! তাই সময় থাকতে এ বদভ্যাস ত্যাগ করুন। অন্যদের ভাবনা নিয়ে না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবুন। তাতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে, নিজের দিকেই শুধু ফোকাস রাখতে পারবেন, ফলে জীবনে সফলতার সুযোগ বেড়ে যাবে বহুগুণ।
৬. অন্যের সাফল্যে বেশী নজর দেওয়া
সুখী হতে সন্তষ্টি অনেক প্রয়োজন। আপনি কী করছেন না করছেন সেদিকে খেয়াল না করে আরেকজনের সাফল্যে নজর বেশী রাখলে কখনোই সন্তুষ্টি আসবে না৷ আর আপনার যদি আর কোনো দোষ না থেকেও থাকে, এই একটি দোষই আপনাকে অসুখী করতে যথেষ্ট। সোশ্যাল মিডিয়ার 'কল্যাণে' এই দোষে দোষী আমরা প্রায় সবাই-ই।
ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামে অন্যের সফলতার খবর, সুখের জীবন দেখে নিজেদের জীবন নিয়ে আমরা অসুখী হয়ে পড়ি। আমরা ভুলেই যাই- মানুষের সে অংশটিই আমরা দেখতে পাই, যা সে দেখাতে চায়। তাই কারো আলোকিত অংশ দেখে ভাববার কোনো কারণ নেই যে তার অন্ধকার অংশ নেই। অন্যের সফলতা-ব্যর্থতায় প্রভাবিত না হয়ে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হোন, ধৈর্য্য রাখুন, সফলতা আসবেই।
৭. অন্যের মতামতকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া
অন্যের মতামতকে অবশ্যই সম্মান দেখানো উচিত। কিন্তু অনেক সময় অন্যের মতামতকে বেশী গুরুত্ব দেওয়াও অসুখী হবার কারণ হয়ে যায়। ধরেন আপনি খুব পছন্দ করে দাম দিয়ে একটি পোশাক কিনে আনলেন। কিন্তু আপনার কোনো এক বন্ধু পোশাকটি দেখার সাথে সাথে বললো এত দাম দিয়ে কেন এটি কিনলেন, সে হলে ফ্রীতেও আনতো না সেটি। তার মতামত শুনে আপনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন৷ আসলেও কি ঠকেছেন? এ নিয়ে শুরু হয়ে গেল মনে খচখচানি, অশান্তি। তাই অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিবেন অবশ্যই, কিন্তু সবার আগে নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিতে শিখুন।
৮. অতীত এবং ভবিষ্যতকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেওয়া
বলা হয়- যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ। আসে দিন খারাপ হবে কিনা সেটা নির্ভর করবে আপনার বর্তমানের উপর। যে দিন চলে গেছে, সেইসব দিনের কথা ভেবে শুধু শুধু কষ্ট পাবার কোনো মানে নেই। আবার আগত দিনগুলোতে আপনার জীবনে কী হতে যাচ্ছে সে ভাবনাও করে লাভ নেই। এতে বর্তমানটাই নষ্ট হবে কেবল, কাজের কাজ কিছুই হবে না। মাঝ থেকে শেষ হয়ে যাবে আপনার বর্তমান জীবনের সুখ-শান্তি। তাই অতীতকে জীবনে উঁকি দিতে দিবেন না, এবং যখন ভবিষ্যত ভাবনায় ডুবে যাচ্ছেন মনে হবে, তখন তপুর গাওয়া গান গেয়ে ফেলবেন চট করে- এত ভেবে কী হবে? ভেবে কে কী হয়েছে কবে?
শেষকথা- জীবনে অনেকসময়ই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায় আসে, যে অধ্যায়গুলো আসার পেছনে হয়তো আপনার কোনো দোষ ছিল না। আপনি হয়তো জীবনকে এক রকম দেখতে চেয়েছেন, কিন্তু জীবন আপনাকে অন্য রঙ দেখিয়েছে, হোক তা পরিস্থিতি কিংবা অন্য কোনো কারণে। 'কেন আমার সাথেই এমনটা হতে হলো' সমীকরণ মেলাতে চাই আমরা তখন। অথচ এ চেষ্টাটুকু না করাই ভাল। নিজ বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে দোষারোপ না করে এক্ষেত্রে জগদ্বিখ্যাত জাপানিজ লেখক হারুকি মুরাকামির একটি লাইন মনে রাখা যায়- there's ton of things out in the world, you've never laid your eyes on, things you never could imagine. যা আপনার বোঝার বাইরে, জোরজবরদস্তি করে তাকে বোঝার কিছু নেই। এতে জীবনে জটিলতা বাড়ে বৈ কমে না।
জীবনটাকে সহজ-সরলভাবে নিতে শিখুন। জটিলতা এড়িয়ে সহজ-সরল জীবন যাপন করার জন্য যে দুটি গুণ থাকা আবশ্যক, তা হলো- ক্ষমা করে দেওয়া এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। এ দুটি গুণ ধারণ করার চেষ্টা করুন, দেখবেন 'অসুখী' টার্মটাই আপনার জীবন থেকে চলে গেছে। হ্যাপিনেস ইজ আ চয়েজ। চুজ ইট ইন ইয়্যুর ওয়ে। হ্যাপি লিভিং!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন