বাংলাদেশী ডাক্তাররা কেন জাতীয় বীর হতে পারলো না তার ৮ কারণ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

অষ্টব্যাঞ্জনের মতোই অষ্টকারণে বাংলাদেশী ডাক্তাররা করোনার মতো প্যানডেমিকেও হিরো হতে পারলো না। এই আফসোস নিয়ে তাদের বাকীটা জীবন বেঁচে থাকতে হবে।
১.
চায়নিজ ডাক্তারদের মতো সেইফটি গগলস ভাগ্যে জোটেনি। মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক, মাথায় পলিথিন পরলেও চোখ খালি থেকে যাচ্ছে। কেউকেউ নিজেদের চশমা ব্যবহার করছেন। সেইফটি গগলস জুটলে হয়তো সারাদিন পরে থাকলে সন্ধ্যায় খোলার পর মুখে দাগ থাকতো। সেই দাগসহ সেলফি ফেসবুকে আপলোড দিতো, জনগণ ডাক্তারদের ডেডিকেশন দেখে হাহুতাশ করতো, চোখ কপালে তুলে স্যালুট দিতো। একটিমাত্র গগলসের অভাবে জনগণের প্রত্যাশীত স্যালুট পাচ্ছে না ডাক্তাররা।
২.
বাংলাদেশী ডাক্তাররা করোনা ভাইরাসে মরছে না। দুই চারজন নয়, ইতালির মতো ত্রিশজন মরলেও এদেশে লাভ নেই। সর্বনিম্ন শ'খানেক ডাক্তার চব্বিশঘন্টার মধ্যেই মারা পড়লে হয়তো ফেসবুকে দুয়েকটা ভিডিও আসতো। ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকতো হাই ভল্যুম, লো পিচের ভায়োলিনের সুর। আমরা জণগণ ভিডিওর মিউজিক শুনে হিপনোটাইজড হয়ে লম্বা স্যালুট দিতাম। ডাক্তারদের জাতীয় বীর ঘোষণা করতাম। কেউকেউ 'You are real Hero' লিখে আড়াইটা লাভ ইমো (সবগুলো ইমো ব্রোকেন হবে) দিয়ে শেয়ার দিতাম। শুধুমাত্র ডাক্তারদের লাশের অভাবে Real hero বলার সুযোগ হচ্ছে না।
৩.
বাঙ্গালি ডাক্তারদের করোনা ভাইরাস আক্রমণ করছে না। করলে হয়তো কর্মক্ষেত্রের লেডি ডাক্তাররাও ভয়ে চুলটুল কেটে ফেলতো। ন্যাড়া করে পলিথিনের টুপি পরলেও নারীদের ন্যাড়া করার সেই ভিডিও ফেসবুকে আসতো। এমন অভুতপূর্ব ভিডিও দেখেও আমরা এদের ফেরেসতা কিংবা দেবী দূর্গা বলে উপাধি দিতাম। ফেমিনিস্টরা 'নারীরা সেক্স টয় নয়, নারীরা মা নয়, নারীরা হলো ইয়ে টিয়ে' লিখে পৌনে একশো কলাম লিখে ফেলতো। টানটান উত্তেজনা আর তুমুল রকম কমেন্ট-রিকমেন্ট চলতো। শুধুমাত্র চুল না কাটার জন্য তারা ফেরেসতাও হতে পারলো না, দেবী দূর্গাও হলো না। এই আফসোস ডাক্তারদের চিরকাল বয়ে বেড়াতে হবে। নো ডাউট!
৪.
বাংলাদেশি ডাক্তারদের স্ত্রী, পুত্র কণ্যা নাই। থাকলেও তাদের প্রতি মায়া-মহব্বত নাই। ডিউটি শেষে হয়তো তারা ঘরে না ফিরে হাওয়া খেতে পার্কে যাচ্ছে, হোটেলে হোটেলে রাত কাটাচ্ছে। এসব কারণ না হলেও নিশ্চিত তাদের ভালো ক্যামেরাওয়ালা মোবাইলফোন নাই। মোবাইলফোন থাকলে হয়তো সন্তানদের দূর থেকে দেখতো। বাবারা থাকরো বাড়ির গেটে কিংবা রাস্তার উল্টোপাশে। সন্তানদের কাছে আসতে বাবারা নিষেধ করতো। বাবা ডাক্তারের বোবাপ্রাণির মতো চোখভর্তি পানি থাকতো। সেই দৃশ্যের ভিডিও উঠিয়ে ভাইরাল করতে পারতো তাদের গৃহিনীরা। শুধুমাত্র স্ত্রী-কন্যার অভাবে চীরকুমার, চীরকুমারী থাকার কারণে কিংবা এতিম হবার কারণে ডাক্তারদের জাতীয় বীর হবার সুযোগ মাঠে মারা গেলো। পরেরবার এমন এপিডেমিক আসার আগে যদি ডাক্তাররা গণহারে বিয়েশাদী না করে, ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল না কেনে তাহলে এই আফসোস নিয়ে তাদের কবরে যেতে হবে।
৫.
ডাক্তারদের বাড়ির আশেপাশের মানুষরা সিঙ্গার নয়, তাদের গিটার নেই, বাশী নেই কিংবা অমিতাভ বচ্চন ফ্যামিলির মতো এদেশের মানুষদের অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল-চামুচ নেই। থাকলে হয়তো বিল্ডিং এর ছাদে উঠে সবাই পাতিল বাজিয়ে ডাক্তারদের উৎসাহ দিতো। অতি উৎসাহীদের কেউকেউ সোলজারদের মতো দুই পা ধুপধাপ করে ঠাসঠাস করে স্পষ্ট স্বরে বলতো- আপনাদের জানাই স্যালুট! ইউ আর রিয়েল হিরো ব্র!
৬.
বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে কাপল ডাক্তার নাই কিংবা ডাক্তারদের সম্ভবত অন্তঃপেশা-প্রেমকাহিনী, বিবাহ নাই। থাকলে হয়তো প্রেমিক-ডাক্তার ও প্রেমিকা-ডাক্তার একই হসপিটালে করোনা ট্রিটমেন্টের ফাঁকে পরস্পর একমিটার দূরে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে, প্রেমময় চাহুনিতে তাকিয়ে থাকতো। ক্যামেরাওয়ালা মোবাইলফোন দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিতে পারতো। তাদের মুখে থাকতো মাস্ক। মাস্কের আড়ালে তাদের বেদনা থাকতো গোপণ। এই ছবি ইতালির লোকজন শেয়ার করে হাহুতাশ করতো, বাংলাদেশের মতো এমন ডাক্তার কাপল তাদের দেশে নেই কেনো? ইতালির জনগণের কাছে বাংলাদেশী ডাক্তাররা এই একটি কারণেই লিজেন্ড হতে পারলো না। এই একটিমাত্র আফসোস নিয়ে ইতালির জনগণ করোনায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
৭.
বাংলাদেশি ডাক্তাররা সম্ভবত মানুষ নয়। এলিয়েন কিংবা মাকামে পৌছে যাওয়া মহামানব পর্যায়ের। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনতা ও জাগতিক অনুভূতির উর্ধে চলে গেছে। তারা এসব এপিডেমিক সামাল দিবেই, এটা তাদের আজন্ম দায়িত্ব। সেবাই তাদের পরম ব্রত। এর বিনিময়ে তারা ৪০ লাখ লাইফ ইনস্যুরেন্স পাচ্ছে। আশিয়ান সিটিতে দুইকাঠা প্লট পাচ্ছে। এজন্যই জনগণ এমন জরুরি অবস্থায় তাদের সম্মান জানানোর প্রয়োজন বোধ করছে না। যে কাজ টাকার প্লট-টাকার তাদের কীসের বীরত্ব!
৮.
হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের ৩% ডাক্তার ভালো ভিজিট নিয়ে ঔষূধ কোম্পানির কমিশন খেয়ে বাড়িগাড়ি করে ফেলছে। বাকী ৯৭% জন ডাক্তার যেহেতু ইনকাম করতে পারছে না, সারাদিন সারারাত ডিউটির ফাঁকে পড়ালেখা করতে আপাদমস্তকের চুল ফেলে, চুল পাকিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে তাই তারা নিজেদের টাকায় দৈনিক ১৫০০ টাকার পিপিই কিনতে পারছে না। শুধুমাত্র টাকার অভাবে পিপিই কিনতে না পারার জন্য তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কশাই হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। নিজেদের বাড়ি, বাড়িভিটা বিক্রি করে দুইমাসে ৯০ হাজার টাকা দিয়ে পিপিই কিনতে পারলে হয়তো সব ডাক্তারই হিরো হয়ে যেতে পারতো। ১০০% ডাক্তারকে কেন বাড়ি-গাড়ি-গৃহস্থালি জিনিসপত্র ঔষুধ কোম্পানিগুলো এতদিন দেয়নি, এই আকাঙ্ক্ষাতে এবং জনগণের 'কেন নিজের টাকায় কিনছে না; এই অভিসম্পাতেই ডাক্তাররা এই ক্রান্তিকালে হিরো হতে পারলো না।
অষ্টব্যাঞ্জনের মতোই অষ্টকারণেই বাংলাদেশী ডাক্তাররা করোনার মতো প্যানডেমিকেও হিরো হতে পারলো না। এই আফসোস নিয়ে তাদের বাকীটা জীবন বেঁচে থাকতে হবে। কারণ ৪০/৫০ বছর পর এমন প্যানডেমিকে (বৈশ্বিক মহামারি) হিরো হবার সুযোগ একবারই আসে। হায় ডাক্তার, হায় ডাক্তার!