জনগণের কাছে এই দোকান যেন একটা ইতিহাস, যারা গল্প শুনেছেন, তারাও এসে অবাক হন, দোকান দেখে ফিরে যান যেন শায়েস্তা খাঁর আমলে...
সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরা জেলা। এই অঞ্চলেই আছে এমন একটি দোকান, যেখানে আজও খাবার মেলে অবিশ্বাস্য কম দামে। জায়গাটা পড়েছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শ্রীরামপুর বাজারে। এই বাজারেই অবস্থিত খাবারের দোকানটি, স্থানীয় জনপদের মানুষদের কাছে যা আট আনার দোকান নামে পরিচিত। এই সময়ে এসে আট আনা/পঞ্চাশ পয়শার কয়েন তো অচলই, তারউপর এক দুইটাকারও যেন আজকাল আর কোনো দাম নেই৷ ভিক্ষুকরাও এক টাকার কয়েন পেলে নাক সিঁটকায়৷
কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে বিরল সাতক্ষীরার আট আনার দোকান যা বছরের পর বছর ধরে কম পয়শায় খাবার বিক্রির ধারা ধরে রেখেছে। কতটা কম, তা শুনলে অবিশ্বাস্যই ঠেকবে। এই দোকানে আপনি সিঙ্গারা খেতে পাবেন মাত্র পঞ্চাশ পয়শায়, আর পরোটার দাম মাত্র এক টাকা! গত ত্রিশ বছর ধরে কত কি বদলে গেল, দ্রব্যমূল্যের উর্ধমুখীতায় মানুষ হতাশ হলো, কিন্তু বাড়লো না এই দোকানের সিঙ্গারা, পরোটার দাম। পরোটার সাথে আবার ডাল ফ্রি! আলুর চপও আছে, বিক্রি এক টাকা প্রতি পিস৷
সাতক্ষীরার এই দোকানটি একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলের দোকানের মতোই, তবুও এটি যেন হয়ে গেছে দর্শনীয় স্থান। অনেকেই আসেন দূর দূরান্ত থেকে, নিজের চোখে দেখে যান এই অবিশ্বাস্য কারবার। দোকানের মালিক মালেক বিশ্বাস। আপাতদৃষ্টিতে তাকে মনে হয় সৎ, নির্বিবাদী, সহজ সরল। ছোট ছাটা সাদা চুল মাথায়, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। এই মানুষটা যেন পণ করেছেন, মানুষকে আট আনায় খাবার খাওয়াবেন আজীবন। বলেন, "বাজারের দ্রব্যমূল্য যতই ঊর্ধ্বগতি হোক না কেন, আমার দোকানে সব খাবারের দাম আট আনাই থাকবে। দোকান থেকে খুব বেশি আয় হয় না। সামান্য পরিমান লাভের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মৃত্যু অবধি আট আনার দোকানটি চালু রেখে যাবো"।
তারপরেও এই দোকান চালিয়ে কী করে সংসার চলে, সেই প্রশ্ন মনের মধ্যে থেকেই যায়। তারও একটা উত্তর এসেছে তার তরফ থেকে। ত্রিশ বছর আগে যখন শুরু করেন তখন দোকান ভীষণ রমরমা। সেই সময় দোকানের বিক্রি থেকে লাভের টাকা জমিয়ে কিছু জায়গা কিনেছিলেন। সেই জায়গা ইজারা দিয়ে, ফসল টসল ফলিয়ে যা আসে, সেটাই মূলত সংসারের মূল আয়।
এত কিছুর মধ্যেও দোকানের খাবারের দাম না বাড়ানোর কারণ হলো, নিজের প্রতি সৎ থাকা, মানুষের কাছ থেকে যে ভক্তি শ্রদ্ধা পেয়েছেন সেটা ধরে রাখা। ব্যবসায়ে সবসময় লাভের বিচার করলে হয় না, সেবার মনও থাকতে হয়। এরকমই দর্শন মালেক বিশ্বাসের। আর মালেক বিশ্বাসের বিশ্বাস যে কতখানি সত্য তা দোকানের ভীড়ভাট্টা দেখলে বোঝা যায়। সারাদিনই দোকানে ভীড় লেগে থাকে এই আশ্চর্য দোকানে।
জনগণের কাছে এই দোকান যেন একটা ইতিহাস, যারা গল্প শুনেছেন তারাও এসে অবাক হন, দোকান দেখে ফিরে যান যেন শায়েস্তা খাঁর আমলে। এত কম দামে খাবার বিক্রির কথা তো ভাবাই যায় না। দিনের খাবার দিনেই বেচা হয়ে যায় একেবারে, আবার নতুন দিনে নতুন ফ্রেশ খাবার নিয়ে হাজির হন মালেক বিশ্বাস।
এই যুগে যখন ব্যবসায়ীরা ওত পেতে থাকে ফন্দি ফিকির করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানোর জন্যে, খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে বাড়তি লাভ করাই যখন এখন মূল উদ্দেশ্য অনেকের, সেই সময়ে মালেক বিশ্বাস এক বিরল উদাহরণই! এমন মালেক বিশ্বাসদের মতো মানুষরা আছে বলেই আজও চমকে যাই, অদ্ভুত ভাললাগায় ছেয়ে যায় মন! বেঁচে থাকুক এই মানুষগুলো, বেঁচে থাকুক সততা...
তথ্য কৃতজ্ঞতা- যমুনা টিভি *
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন