রিয়াল মাদ্রিদ যদি স্পেনের ও ইউরোপের সফলতম ক্লাব হয়, তাহলে সার্জিও রামোস ৩৪ বছর বয়সে ৩৪তম লীগ জিতে সেই দলের সফলতম নেতা হবার দৌড়ে শুধু এই মৌসুমেই এগিয়ে গেলেন যোজন যোজন ক্রোশ...

খেলাধুলার ব্যাপারে মানুষের স্মৃতিশক্তি কাজ করে গোল্ডফিশের মতো। সেটা করে বলেই খেলোয়াড় ও দলের কোয়ালিটির সাথে সাথে ফর্মের বিষয়টিও খেলাধুলার মৌসুম জুড়ে থাকে বহুল আলোচিত। এই যে ধরুন রিয়াল মাদ্রিদের এই মৌসুমের শত মিলিয়নের সাইনিং এডেন হ্যাজার্ড এর কথাই। প্রিমিয়ার লিগে মৌসুমের পর মৌসুম  ধরে ছিলেন চেলসির আক্রমণভাগের মূল ভরসা।

অথচ রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আজন্মলালিত স্বপ্ন পুরো করার পর ইনজুরী আর ফর্মের খরায় এমনই এক মৌসুম কাটাচ্ছেন যে, সেসব মনে হচ্ছে বহুদিনের পুরাতন ইতিহাস। হ্যাজার্ডের চেলসির দিনগুলির কথা মনে করতে করতে স্মৃতিকে আরেকটু ব্যায়াম করিয়ে আনুন আর ফিরে যান হ্যাজার্ড যখন রিয়াল মাদ্রিদে এলেন সেই সময়ে। 

সেটাও মনে হবে এক  অন্য সময়ের গল্প। প্রাক মৌসুমে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে সাত গোল খেয়ে রীতিমত লেজেগোবরে এক মৌসুমের ইংগিত দিচ্ছিল লস ব্লাংকোসরা। হ্যাজার্ডের হবার কথা ছিল রিয়াল মাদ্রিদের ত্রাণকর্তা, হবার কথা ছিল রিয়াল মাদ্রিদের সোনালী আভিজাত্যের আগুনে নতুন স্ফুলিঙ্গ। অথচ আলফ্রেডো ডি স্টেফানো স্টেডিয়ামে হ্যাজার্ড শিরোপার সাথে ছবি তুলছেন আপনার মেমরি ট্যুর আপনাকে জানিয়ে দেবে সেটা না হয়ে উলটো রিয়াল মাদ্রিদের এই দলটিই হ্যাজার্ডকে শিরোপার সাথে মিলিয়ে দিয়েছে! 

অংকের হিসাবে দুই মৌসুম পর স্পেনের এক নম্বর দলের মর্যাদা আবার রিয়াল মাদ্রিদের ঘরে। ৩৪ শিরোপা নিয়ে ইতিহাসে স্পেনের সফলতম দলের তকমাটা আরেকটু বরং পাকাপোক্ত হল সাদা সোনালী দলের। অথচ ইতিহাস ঘেঁটে এরকম রিয়াল মাদ্রিদ দল সম্ভবত আর একটি পাবেন না। এ দলের গল্পটা অন্য সব রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে আলাদা বলেই এই শিরোপা আর দশটি শিরোপার মত নয়। হবে কি করে বলুন? এই মৌসুমই যে আর দশটা সাধারণ মৌসুমের মত নয়। সেটা শুধু লা লীগা চলার মাঝপথে দুই মাসের কোভিড ১৯ সংক্রান্ত বিরতির কারনেই নয়, লা লীগায় রিয়াল মাদ্রিদ বার্সেলোনা দুই দলেরই চরিত্রবিরোধী অধারাবাহিকতার কারণেও।

বিরতির আগে মনে হচ্ছিল, কোন দলই যেন শিরোপা জিততে আগ্রহী নয়। এল ক্লাসিকো জিতে রিয়াল পয়েন্ট টেবিলে এগিয়ে গিয়ে কয় ম্যাচ পরেই আবার বার্সাকে ছেড়ে দিয়েছিল শীর্ষস্থান ক্রমাগত পয়েন্ট হারিয়ে। আবার তার আগে জানুয়ারীতে রিয়াল প্রথম পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে উঠেছিল ও বার্সার ক্রমাগত অধারাবাহিক পারফরমেন্সের জের ধরেই। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসের অন্য সব রিয়াল মাদ্রিদ দলের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকবে তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারনে। তারা যে ব্র্যান্ডের ফুটবল খেলে থাকে, তাতে যতদিনের কথা আপনি মনে করতে পারবেন আপনার মানসপটে আসবে বিশ্বসেরা সব আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আর তাদের গোলের ছবি। রিয়াল মাদ্রিদ যখন শিরোপা জেতে তার পিছনে তাদের প্রতিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার মানসিকতাই হয়ে থাকে মূলনীতি। 

জয়োল্লাস 

আধুনিক রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যুগে মৌসুমে ১০০ গোল করা দল দেখতে দেখতেই বড় হওয়ায়, এর বাইরে রিয়াল মাদ্রিদ অন্যভাবেও যে খেলতে পারে সেটাই তো সবার স্মৃতি থেকে একরকম হারিয়ে গেছে। ২০১৯-২০ মৌসুমের এই শিরোপাজয়ী দলের নামের পাশে সেখানে দেখা যাচ্ছে মাত্রই ৬৮ গোল! এর চেয়ে কম গোল করে সর্বশেষ তারা শিরোপা জিতেছিল ২০০৬-০৭ মৌসুমে। ফ্যাবিও ক্যাপেলোর অধীনে। 

সেবার বার্সার সাথে সমান পয়েন্ট নিয়ে লীগ শেষ করলেও হেড টু হেড নিয়মে শিরোপা চলে আসে স্পেনের রাজধানীতে। কিন্তু ক্যাপেলোর মত রক্ষণশীল ম্যানেজারের অধীনে রিয়ালের জালে বল ঢুকেছিল ৪০ বার! এবারে প্রাক মৌসুমে সেই সাত গোল খাওয়া ম্যাচের পর সবাই ডিফেন্স নিয়ে গেল গেল রব তোলার পরও রিয়ালের ডিফেন্স মৌসুমজুড়ে লিগে মাত্র হজম করেছে ২৩ গোল। কোনভাবে শেষ ম্যাচটিতে নিজেদের জাল সুরক্ষিত রাখতে পারলে, লা লীগা ২০ দলের লিগে রুপান্তরিত হবার পর থেকে এটাই হতে যাচ্ছে কোন মৌসুমে রিয়ালের সবচেয়ে দুর্দান্ত ডিফেন্সের রেকর্ড। 

এই রেকর্ডের কারিগরদের মধ্যে সবার প্রথমেই আসবে থিবো কর্তোয়ার নাম। বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক হয়ে যখন মাদ্রিদের খাতায় নাম ওঠে তার, খোদ রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরাই তাকে দুষছিলেন সমর্থকপ্রিয় কেইলর নাভাসের বেঞ্চে বসা ও পরে বিদায়ের কারণ হয়ে দাঁড়ানোয়। 

সেই ফুটন্ত কড়াইতে আরো তেল ঢেলে দিতেই কর্তোয়ার জন্য এর আগের মৌসুমটি ছিল ভয়াবহ বাজে। সে মৌসুমের পর প্রাক মৌসুমে এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গোল খাওয়ার ধারা অব্যাহত রাখায় অনেকে দেখে ফেলেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে কর্তোয়ার ক্যারিয়ারের শেষও। কিন্তু মৌসুম শেষে স্পেনের সেরা গোলরক্ষক হওয়ার দৌড়ে কর্তোয়া তো আছেনই, সাথে আর এক ম্যাচ নিজের জাল সুরক্ষিত রাখতে পারলে যে মৌসুম তিনি কাটাবেন তার মত আরেকটি মৌসুমের সন্ধানে আপনাকে কেইলর, ক্যাসিয়াস, লোপেজ, ইগনার এর মত বড় বড় নাম পার হয়ে যেতে হবে ৯০ এর দশকের কিংবদন্তী বুয়ো পর্যন্ত। 

রিয়াল মাদ্রিদ গত মৌসুমের হতাশাজনক পারফরমেন্সের পর নতুন করে সাইন করায় বেশ কয়টি। এর মধ্যে এডেন হ্যাজার্ড ছিলেন সবচেয়ে বড় নাম। আইকনিক সাত নাম্বার জার্সিটার ভার তাঁর হাতে তুলে দিয়ে চিন্তামুক্ত হতে চাইলেও হ্যাজার্ডের জন্য মৌসুমটা হয়ে থাকবে মন্দভাগ্যের ছবি হয়েই। কিন্তু আরেকজন নতুন সাইনিং ফার্ল্যান্ড মেন্ডি কিন্তু এই শিরোপায় নিজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দুটি কথার দাবী তুলে ধরতেই পারেন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রথম মৌসুমের চাপে পিষ্ঠ হয়েছেন এডেন হ্যাজার্ডের মত সুপারস্টার, কর্তোয়ার মত পরীক্ষিত গোলরক্ষক থেকে কত শত খেলোয়াড়। এর সাথে যোগ করে নিন মার্সেলোর মত কিংবদন্তী ডিফেন্ডারের সাথে দলে জায়গা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মেন্ডি যে উতরে গেছেন লেটার মার্ক পেয়ে, তার সাক্ষ্য দেবে মৌসুমের শেষ দিকে সব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে টিমশিটে তার নাম আর তিনি দলে থাকলে দলের সাধারনভাবে ভালোর চেয়েও ভাল ডিফেন্সিভ পরিসংখ্যান। 

চ্যাম্পিয়ন দল 

তিনবারের চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ী ও কোপা ডেল রে বাদে সম্ভাব্য সকল শিরোপাজয়ী দলে পরিবর্তন আনাটা যেমন কঠিন, তেমনি অনেক সময় দরকারীও হয়ে ওঠে। সর্বজয়ী খেলোয়াড়দের মোটিভেট করাটা হয়ে যায় আলাদা একটা চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের ওল্ডগার্ড যে এখনো রিয়াল মাদ্রিদের হার্টবিট তা প্রমাণ হয়েছে বারে বারে। শুরুর কিছু বিচ্ছিন্ন ম্যাচ বাদ দিলে ড্যানি কার্ভাহাল, টনি ক্রুস, রাফায়েল ভারান সারা মৌসুম জুড়েই ছিলেন ধারাবাহিক। দলে তাদের অবদান অনেক সময় দৃশ্যমান না হলেও তারা ঠিকমত নিজেদের কাজটি করতে পারেন যখন, তখনই দল হিসাবে রিয়াল মাদ্রিদ ভাল খেলে। পরিবর্তনের এ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের দর্শনগত পরিবর্তনের আরেক নজির ছিল তরুণ তুর্কিদের দলে জায়গা করে নেয়ার ব্যাপারেও। সেটা এতটাই যে ওল্ডগার্ডের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনানীদের একজন, ব্যালন ডি অর জয়ী লুকা মদ্রিচ দলে জায়গা হারিয়েছিলেন তরুণ ফেদে ভালভার্দের কাছে। 

ফেদে গোটা মৌসুমে রিয়ালের সবচেয়ে দুর্দান্ত পারফরমার হয়ে উঠলেও রিয়াল মাদ্রিদের মতোই মদ্রিচও ফেরত এসেছেন দুরন্তভাবে। সাথে সাথে দুই টিনেজার রড্রিগো আর ভিনিসিয়াস জুনিয়রও নিয়মিতই টিমশিটে নিজেদের নাম দেখতে পেয়েছেন আক্রমণভাগে। সাথে মাঝে মাঝে ডাক পড়েছে নতুন আসা তরুণ ডিফেন্ডার এডার মিলিতাও এরও। 

কিন্তু ওল্ডগার্ডের সবচেয়ে কম প্রশংসা পাওয়া করিম বেনজেমাকে শিরোপার কৃতিত্ব দিতে হবে বহু দিক থেকে। ১৯ গোল করে স্পেনের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার দৌড়ে বেনজেমা তো এখনো শক্তভাবে আছেনই, সাথে সাথে পুরো মৌসুমজুড়ে তিনি ছিলেন দলের আক্রমণের মূল হুমকি। ছিলেন দলের একদমই তরুণ আক্রমণের মনস্তাত্বিক নেতা এবং বরাবরের মতই নিঃস্বার্থ দলপ্রাণ খেলোয়াড়। তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে তৈরি এর রিয়াল মাদ্রিদ হয়তো ইউরোপে দর্শনধারিতার বিচারে খুব উপরে থাকবে না, কিন্তু ভারসাম্য আর দলীয় সংহতির বিচারে এরকম সলিড ইউনিট হয়ে খেলতে পারা দল খুঁজে পেতে আপনাকে কষ্ট করতে হবে বেশ এ কথা একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও বলে ফেলা যায়। 

একটি চ্যাম্পিয়ন দলের বীরত্বগাঁথা তৈরি হয় ছোট ছোট ঘটনা থেকে। এ মৌসুমে দুটি এল ক্লাসিকোর একটিতেও না হারা, শেষ মুহুর্তে মারিয়ানো ডিয়াজের গোলে ক্যাম্প ন্যু থেকে সরাসরি শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষায় পাস করে আসা, ভিনিসিয়াস জুনিয়রের লেফট উইং ধরে দেয়া একের পর এক ক্লোজ ড্রিবল, ড্যানি কার্ভাহালের আক্রমণভাগে ঝাপটার মত লেগে থাকা, গোললাইন থেকে থিবো কর্তোয়ার প্রতিপক্ষের বক্সে গিয়ে এসিস্ট করে পরাজয় ঠেকিয়ে আসা কিংবা ৩০০ দিনের বেশি মাঠের বাইরে থাকা আসেন্সিওর মাঠে ফিরেই ৩১ সেকেন্ডে প্রথম টাচে গোল করার মত এমন ঘটনার অভাব নেই একদমই। 

কিন্তু এরকম ছোট ঘটনা সবচেয়ে বেশি জন্ম দিয়েছেন যিনি তিনি রিয়াল মাদ্রিদ এর আইকনিক খেলোয়াড় ও অধিনায়ক সার্জিও রামোস। অনেকেই বলেন ফুটবল মাঠে অধিনায়কের ভূমিকা শুধুই আর্মব্যান্ড পড়া। নেত্তৃত্ব দিতে হয় পারফরমেন্স দিয়েই। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অভাব কীভাবে রিয়াল মাদ্রিদ পূরণ করবে এই প্রশ্ন আজও অনেকের মুখে মুখে ফেরে। 

কিন্তু কাউকে যদি এটা বলা হত যে, সার্জিও রামোস হবেন রোনালদোর রিপ্লেসমেন্ট, তাহলে অনেকে স্রেফ পাগল ঠাওরাতেন বক্তাকে। এটা সত্য যে রোনালদোর মত নিয়মিত ৫০ গোল করা ফরোয়ার্ড হয়তো আর পাওয়া যাবে না, কিন্তু রামোস এই মৌসুমে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সুপারস্টার আর 'ফিয়ার ফ্যাক্টর'-এর অভাবে রিয়াল মাদ্রিদকে ভুগতে হবে না তত দিন অন্তত, তিনি যত দিন সাদা জার্সি গায়ে দলের হয়ে লড়ছেন। দলের ডিফেন্সের নেতা তিনি অনেকদিন আগে থেকেই। রোনালদোর সময়েও দলের সবচেয়ে বড় জয়গুলিতে ক্যাপ্টেন সার্জিও কখনো কখনো ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের শেষ আশা ভরসার স্থান। 

কিন্তু দলের নতুন এই গড়ে ওঠার সময়ে দলের জন্য সার্জিও রামোস যা যা হতে পারেন তাঁর কিছুই যে আর বাকি নেই! রামোসের এই মৌসুমের বীরত্বগাথা নিয়ে লেখা যাবে ছোটখাট একটা বইও! কিন্তু একনজরেও যদি দেখা যায়-

  • মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ এর হয়ে ১০ গোল। (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)
  • টানা ১৭ পেনাল্টিতে গোল করার অবিশ্বাস্য রেকর্ড।
  • লা লীগার ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া।

এরকম দুর্দান্ত অর্জনগুলি লেখা থাকবে ইতিহাসে লম্বা সময় ধরেই। রোনালদো পরবর্তী যুগে দলের মূল ডেডবল স্পেশালিস্ট হয়ে ওঠা কিংবা নিজের হেডিং ক্যাপাসিটির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ছাপও পরিসংখ্যানে থাকবে। 

কিন্তু পরিসংখ্যান যা বলবে না, তাতে থাকবে রামোস উঠে যাবার পর দলের মানসিকভাবে খেই হারিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে নেতৃত্ব শুধুই আর্মব্যান্ড নয়, থাকবে দলের ১-০ গোলের ব্যবধানে জেতা একের পর এক ম্যাচে দলের একমাত্র গোলের উৎস হয়ে থাকা কিংবা ৯০ মিনিটে প্রতিপক্ষের বক্সে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক সেন্টারব্যাকের গোল আদায়ের প্রাণান্ত চেষ্টা। রিয়াল মাদ্রিদ যদি স্পেনের ও ইউরোপের সফলতম ক্লাব হয়, তাহলে সার্জিও রামোস ৩৪ বছর বয়সে ৩৪তম লীগ জিতে সেই দলের সফলতম নেতা হবার দৌড়ে শুধু এই মৌসুমেই এগিয়ে গেলেন যোজন যোজন ক্রোশ। 

ফুটবল দলে যদি অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পড়াকে কেন্দ্র করে নেতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে কারো আপত্তি থাকেও তাহলেও সবাই বিনা বাকে মেনে নেবেন মাঠের বাইরের নেতাই একটি ক্লাবের আসল নেতা। রিয়াল মাদ্রিদে এই নেতৃত্বের আসনটার আনুষ্ঠানিক নাম কোচ। এই আসনের গরমে বহু ফুটবল জিনিয়াস তপ্ত হয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন, খেই হারিয়েছেন। 

এই যে গত মৌসুমে পত্রপাঠ বরখাস্ত হওয়া জুলেন লেপেতেগুই সেভিয়াকে নিয়ে প্রমাণ করেছেন অতটা খারাপ কোচও তিনি নন। রিয়াল মাদ্রিদের আদরের সন্তান সান্তিয়াগো সোলারিও টিকতে পারেন নি। ঘরের আগুন নেভাতে রিয়াল যাকে আবার ডেকে এনেছিল তিনি যে শুধু নায়ক নন, রীতিমত মহানায়ক। ফুটবল রোমান্টিসিজমের কোন উপন্যাস থাকলে জিনেদিন জিদান শুধু খেলোয়াড় হিসাবেই সর্বকালের অন্যতম সেরা। নবম চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সে গোলই তাকে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে অমরত্ব এনে দিতে যথেষ্ট ছিল। 

কিন্তু ম্যানেজার জিদান? ম্যানেজার জিদান টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সহ ১১ ট্রফি জিতেও অনেকের মতে ছিলেন শুধুই ভাগ্যবান। জিদানের হয়তো কারো সামনে প্রমাণ করার মত কিছু নেই। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিতে ভালো না বেসে কি কেউ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফুটবলে? 

জিদান প্রথমবার এসেছিলেন। দেখেছিলেন এবং জয়ের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের জাহাজকে। এবার যখন আবার দলের হাল ধরতে এলেন প্রিয় সারেংদের কেউ হয়তো নেই, কেউ বুড়িয়ে গেছেন, কেউ হারিয়েছেন মনোযোগ।

২০০৬ সালের ফ্রান্স দলের যখন বিশ্বকাপ শুরু করে তাঁদের ঢাল তলোয়ার ছিল না। ছিল শুধুই জিনেদিন জিদান। সেটুকু সামলাতেই সোনালী প্রজন্মের ব্রাজিল আর স্পেনের বিশ্বকাপ স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এই রিয়াল মাদ্রিদ দলেও হয়তো রয়ে গেছে বড় শুন্যস্থান, হয়তো এই দলের সেরা তারকারা এখনো নিতান্তই কিশোর, হয়তো বুড়িয়ে গেছে ওল্ডগার্ড। কিন্তু ফরাসী জাদুকরের ছোয়ায় যা যা হয় এই সাদা সোনালী ক্লাবে তাঁর কোন গাণিতিক ব্যাখ্যা হয় না। গত মৌসুমে খেলতেই ভুলে যাওয়া দল এই মৌসুমে স্প্যানীশ সুপারকাপের পর লীগ শিরোপা ঘরে তুলে সেটাই যেন আবার জানান দিন উচ্চস্বরে। 

জিদানের চ্যালেঞ্জ অবশ্য এখানেই শেষ হচ্ছে না। অদ্ভুত এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এর হিসাব নিকাশ এখনো রয়ে গেছে বাকির খাতাতেই। সেখানে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির সাথে টপকাতে হবে ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকার বাধা। এই মৌসুমে গ্যারেথ বেল ও হামেস রড্রিগেজ এর দলীয় অবস্থান আটকে আছে একরকম অচলাবস্থা হয়ে। সামনের মৌসুম শুরুর আগে সমাধান করতে হবে সেসবও।

রাইটব্যাকে কার্ভাহালের উত্তরসুরী যাকে ভাবা হত সেই আশরাফ হাকিমি লোন থেকে আর ফিরে আসেননি ব্লাংকোসদের ডেরায়। বয়স বেড়ে যাচ্ছে রামোস, মদ্রিচ, বেনজেমা বা মার্সেলোদের মত বিশ্বস্ত সেনানীদের। খুঁজে ফিরতে হবে এডেন হ্যাজার্ড আর লুকা জোভিচের মতো নতুন আসাদের সেরা পারফরমেন্সও। জিদান কি পারবেন এসব চ্যালেঞ্জ জয় করতে? 

এই প্রশ্নের উত্তর তোলা থাক আগামী মৌসুমের জন্য। এ মৌসুমে সিবেলেস চত্ত্বরে “চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন!” ধ্বনির অনুনাদ না হলেও বাতাসে ভেসে বেড়াক ৩৪ শিরোপা জয়ী নায়কদের ধৈর্য্য, লড়াই আর হার না মানা মানসিকতার স্তুতি। 

*

লেখক- কো-এডিটর, মাদ্রিদ বেতার

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা