নটরডেম কলেজে নাকি অনেক কড়াকড়ি- এসব শুনে আমি একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। কিশোর মন খুঁজে স্বাধীনতা। সে কেন নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হতে চাইবে? কিন্তু...
আমি কখনোই নটরডেমে পড়ব এমন ভাবিনি। ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা কলেজে। নটরডেমে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার পর যেদিন চান্স পেলাম, তখনো মনে হয়নি এখানে পড়া হবে। একদম সৎ হয়ে যদি বলি, নটরডেম কলেজে নাকি অনেক কড়াকড়ি- এসব শুনে আমি একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। কিশোর মন খুঁজে স্বাধীনতা। সে কেন নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হতে চাইবে? কিন্তু, আত্মীয়স্বজনরা ফোন-টোন দিয়ে আব্বাকে বোঝালো। আব্বাও বুঝলেন। আমাকে বললেন, ঢাকা কলেজে ভর্তি বাতিল করে নটরডেমে ভর্তি হয়ে যেতে। বলে রাখি, ঢাকা কলেজ আমার ভীষণ পছন্দের কলেজ, এত ঐতিহ্যবাহী একটা কলেজে ভর্তি হওয়ায় আমি বেশ উৎফুল্লই ছিলাম। কিন্তু, আমি চলে আসলাম নটরডেমে।
২০১৪ সালে আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বের হই নটরডেম কলেজ থেকে। তারপর দিন যত গড়ায়, ততই মনে হয় আমি আসলে ভালবেসে ফেলেছি, এই কলেজটাকে। কী কী কারণে ভালোবাসি, সেটা এত দিন বাদে এখন অনুভব করতে পারছি। এগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধির জায়গা থেকে বলা। সবাই সেই সহানুভূতির জায়গা থেকেই দেখবেন। তাছাড়া কোনো কলেজের প্রতি আমার অসম্মান নেই। আমি মনে করি প্রত্যেকটা কলেজেরই নিজস্বতা আছে। আমি যেহেতু এখানে পড়েছি তাই এখানকার কিছু স্বকীয়তা আমার চোখে পড়েছে। সেগুলোই লিখার চেষ্টা করছি। এর বাইরেও অনেক কিছু থাকতে পারে, যা বলছি তার সাথেও দ্বিমত থাকতে পারে। সেগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।
১। নটরডেমে আমার প্রথম দিন। সকালে অরিয়েন্টেশন। আটটায় শুরু হওয়ার কথা। এই জীবনে সব প্রোগ্রামেই দেখেছি সকাল আটটা মানেই ৮.০০ টা না। সময় নিয়ে কিছু একটা গড়বড় থাকেই। আমি ৮টার কিছুক্ষন আগে কলেজে যাই। কলেজের মাঠে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেখান থেকেই একটা বার্তা পেয়ে যাই। "এই কলেজে সকাল আটটা মানে সকাল ৮টাই, ৯টা না, ১০ টাও না"। সময়ের কাজ সময়ে শুরু করা, সময় মেনে চলার কথা তাঁরা আলাদাভাবে আমাকে বলেননি, নিজেরা নিজেদেরকে দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন। মুগ্ধতা এবং সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা দিয়েই শুরু হয়েছিল সেই প্রথম প্রহর।
২। কলেজ থেকে সবাইকে একটা করে প্ল্যাস্টিক স্বচ্ছ ব্যাগ দেয়া হয়। বই খাতা আনা নেয়া করার জন্যে। এইরকম ব্যাগ আমি কোথাও দেখিনি তখন। অদ্ভুত রকমের ব্যাগ। ভালো লাগত না, আবার মজাও লাগত। কারণ, মানুষ ওই ব্যাগটা দেখলেই বুঝতে পারত এটা নটরডেম কলেজের কোনো ছাত্রের ব্যাগ। কলেজ জীবন শেষ করে দূরে কোথাও বসে এই ব্যাগটাকে এখন আমার "ওয়াটারপ্রুফ স্বপ্নবাহক" মনে হয়। ঘাড়ে করে স্বপ্ন বহন করতে করতে হেঁটে যায় যুবক। কেউ কেউ ঈর্ষা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দেখতে বড় ভালো লাগে।
আরেকটা স্বকীয় ব্যাপার ছিল, ড্রেস কোড ছিল না। নির্দিষ্ট কোনো ইউনিফর্ম ছিল না। অবশ্য আমরাই শেষ ব্যাচ ছিলাম, আমাদের পরের ব্যাচগুলোর জন্য ড্রেস কোডের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই ড্রেসও স্বতন্ত্র্য। দূর থেকে সেই ড্রেস পড়া কিশোরদের দেখলেই চেনা যায়, এই ছেলেটি নটরডেম কলেজে পড়ে!
৩। কলেজে এসে দেখলাম প্রায়ই কোনো না কোনো ক্লাবের অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। নাট্যদল, বিজন্যাস ক্লাব, নেচার ক্লাব, চেস ক্লাব, সায়েন্স ক্লাব, ডিবেট ক্লাব ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যেকটা ক্লাব এত সুন্দর কাজ করে যে একটা যেন আরেকটাকে ছাড়িয়ে যায়। এই ক্লাবগুলোর এক্টিবিটিজে যেন সব ছাত্ররা যোগ দিতে পারে এজন্য প্রতি বুধবার একটা ক্লাস কম হয়। সেই সময়টুকুতে যে যেই ক্লাবের সদস্য ওই ক্লাবের আয়োজনে অংশ নেয়। এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিজের প্রতি ছাত্রদের আগ্রহী করতে চায় কলেজ। ফলে এখানকার জীবন কখনোই একঘেয়ে হয় না।
নটরডেমে প্রতি বছর এখনও যে পরিসরে বিজ্ঞান উৎসব হয়, নাট্যদলের যে বিশাল প্রোগ্রাম হয় এরকম পরিবেশ খুব একটা চোখে পড়ে না কোথাও। শুধু ক্লাব কালচার, নিজেকে চেনা, এক্সপ্লোর করা শেখার জন্যে হলেও এই কলেজ জীবনের দুইটা বছর অনেকের স্মরণীয় হয়ে থাকে।
৪। এখন কলেজের ভর্তি ব্যাপারটা পুরোপুরি অনলাইনে চলে এসেছে। আমাদের ব্যাচের সময় সম্ভবত এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল প্রথম। কিন্তু নটরডেম মানল না। তারা বললো তারা ভর্তি পরীক্ষা নিবেই। ভর্তি পরীক্ষা হয় দুইভাগে- লিখিত, তারপর ভাইভা। আদতে এই ভর্তি পরীক্ষা কিন্তু খুব কঠিন কিছু না। এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা যা দেখা হয়, একটা ছাত্রের মানবিকবোধ, কমনসেন্স এবং তার বেসিক কতটা স্ট্রং সেটা। এই ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোথাও কোচিং করতে হয় না। এই ভর্তি পরীক্ষার পুরো ব্যাপারটা নটরডেম কলেজের অন্যতম নিজস্বতা।
যেদিন ভর্তির ফরম ছাড়ে সেদিন ফরম কেনার লাইন ছাড়িয়ে যায় মতিঝিলের শাপলা চত্বর পর্যন্ত। ভর্তি পরীক্ষার কারণ হলো, নটরডেম গতানুগতিক ফলাফলে বিশ্বাস করে না। তাদের মেধা যাচাইয়ের স্টাইল একান্তই নিজস্ব। ফলে কেউ এসএসসিতে জিপিএ ৫ না পেয়েও নটরডেম কলেজের বিজন্যাস স্টাডিজ, আর্টসের বিষয়গুলোতে পড়তে পারে।
৫। নটরডেম কলেজের সিট প্ল্যানটা একটু অন্যরকম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখেছি, ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়ে সামনের দিকের সিটগুলো দখল করার নেশায় নেমে যায়। আবার সিট নিয়ে চলে স্বজনপ্রীতি। একজন তার বন্ধুবান্ধবের জন্য সিট দখল রাখার জন্য ব্যাগ, কলম দিয়ে সিট দখল করে বসে থাকে। কিন্তু, নটরডেম কলেজে দেখলাম একটা ভিন্ন চিত্র। ফিক্সড সিট প্ল্যান থাকে, কিন্তু ফিক্সড না। প্রতি সপ্তাহে পালটায়। যে সামনে বসছে সে সবসময় সামনেই বসবে, এমন না। তিন সারি করে পেছাবে পরের সপ্তাহে। যারা পেছনে বসেছিল তারা চলে যাবে সামনে।
এই সিস্টেমের কারণে সবাই ঘুরে ফিরে বিভিন্ন অবস্থান থেকে ক্লাস করার সুযোগ পায়। এটা যেন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দুনিয়াকে দেখার লেসন! একটু পরিবর্তন করলে অবস্থান কিভাবে পালটায়, দেখার চোখ কিভাবে পালটায় সেটা শেখানো। এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা তখন বুঝিনি, এখন বুঝি। নিয়ম দিয়েও অনেক কিছু শেখানো যায় সহজে!
৬। কলেজে সবচেয়ে কঠিন ব্যাপারটা ছিল কুইজ পরীক্ষা দেয়া। তখন এটাকে কঠিনই মনে হতো। এত ঘন ঘন এক্সাম বোধহয় আর কোথাও নেই, এমন মনে হতো। কিন্তু, এখন বুঝতে পারি, পরীক্ষাভীতি একেবারে উধাও হয়ে গেছে সেই কুইজ পরীক্ষাগুলোর কারণে। এত বেশি পরীক্ষা দিয়েছি কলেজের দুই বছরে যে এখন বিনা নোটিশে, যেকোনো সময় যেকোনো পরীক্ষায় বসে যেতে পারব। মেন্টাল টাফনেস তৈরি হয়েছে এই কুইজ এক্সামগুলোর কারণে।
মেন্টাল টাফনেসের প্রসঙ্গ যখন আসলোই তখন বলি, নটরডেম কলেজে একজন ফাদারই থাকেন যিনি ছাত্রদের সমস্যা শুনার জন্য বসে থাকেন। তার কাছে যেকোনো সময় যেকোনো সমস্যার কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
৭। আমরা যখন ছিলাম তখনই পুরনো ক্যান্টিন ভেঙ্গে নতুন ক্যান্টিন হয়েছিল। দুইটা ক্যান্টিনে আমরা খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই ক্যান্টিনের সিঙ্গারা আমার সবচেয়ে প্রিয়। একটা খাবারের জন্যেও কলেজকে ভালবাসা যায় সেটা সেই ক্যান্টিনের সিঙ্গারা না খেলে বুঝতামই না। প্রত্যেকদিন দুইটা সিঙ্গারা আর একটা কোকের কাঁচের বোতলের ড্রিংকস থাকতই দিনের কার্যতালিকায়। গরম গরম ধোঁয়া ওড়ানো কলিজা সিঙ্গারা আর সমুচা যে এত মজা হতে পারে, ভাবনার বাইরে।
৮। নটরডেম কলেজ কেনো মেধাতালিকায় প্রথম হয় না এরকম একটা প্রশ্ন অনেকেই তুলে। কিন্তু, সত্যি বলতে নটরডেম কলেজের ভেতরেও কখনো রেজাল্ট ভাল করতেই হবে এই চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া হয় না ছাত্রদের মধ্যে। সহজলভ্য এ+ এর যুগে এমন প্রশ্নের সহজ একটা উত্তর দিয়েছিলেন ফাদার বেঞ্জামিন। তিনি বলেছিলেন, “কোনটা গাছে পাকা আম আর কোনটা ফরমালিনে পাকা, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময়েই টের পাওয়া যায়।”
তার কথাকে সত্যি করে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নটরডেম কলেজের ছাত্ররা অধিক সংখ্যক চান্স পায়। কারণ, নটরডেম কলেজে শুধু এ+ এর জন্যে পড়ানো হয় না, শেখার জন্যে পড়ানো হয়। ক্লাসে আমাদের বলা হতো, তোমরা যদি ভাল রেজাল্ট খুঁজো ভাই, তাহলে অন্য কোথাও চলে যাও। রেজাল্ট কখনো তুমি কেমন মানুষ সেটা প্রকাশ করে না। তুমি যদি মানুষ হিসেবে ভাল হও, সেটাই হবে তোমার সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট।
৯। নটরডেম কলেজ পরিচালনা করতেন খৃষ্টান ফাদাররা। এখানে বিভিন্ন ধর্মালম্বী ছাত্ররা ক্লাস করতে আসে। কিন্তু, কোনো দিন কাউকে আলাদাই মনে হয়নি। কলেজের ভেতরে মসজিদ আছে, আমাদের যাদের নামাজ পড়তে ইচ্ছে হয় আমরা গিয়ে নামাজ পড়ে আসি। খৃষ্টান মিশনারি কলেজের ভেতরে মসজিদ আছে, এখানে যে যার ধর্ম পালন করছে। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের ছাত্ররা পড়ে, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খৃষ্টান, কেউ মুসলিম। কিন্তু, কারো সাথে কারো বিরোধ নেই। সবাই একসাথে বসে ক্লাস করছে।
বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। আদিবাসী ভাইয়েরাও এখানে পড়তে আসে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসে অনেকে। সবাই সমান। এই সাম্যবাদের ব্যাপারটা আমার এতো ভাল লেগেছে যে আজকাল মনে হয় এমন উদারতা যদি সবখানে থাকত!
১০। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে গিয়েই শেষ করি লেখাটা। সেই প্রথমদিন। সেদিন একটা উক্তি শুনেছিলাম। যেটা পরে আরো কয়েকবার শুনেছি কলেজে থাকতেই। আমাদের একটা কলেজের পরিচিতিপত্র বা নিয়মাবলী কি কি আছে এরকম কিছু একটা দিয়েছিল। সেখানে একটা পরীক্ষা হয়েছিল। গতানুগতিক পরীক্ষা না, সেখানে লিখতে হয়েছে নটরডেম কলেজে আসবার পর সব কিছু দেখার অনুভূতি। কোনো উপলব্ধি। সেখানে আমি সেই উক্তির কথা লিখেছিলাম। যেই উক্তিটা এখনও মনে দাগ কাটে। কথাটা বলেছিলেন খুব সম্ভবত ফাদার সুশান্ত। বললেন- Don't think you are "nothing", & don't think you are "everything", You think you are "something", Who can achieve everything.
কেন জানি না, এই লাইনটাই আমার মাথায় গেঁথে যায়। কোনো গান ভাল্লাগলে আমি সেটা বারবার প্লে করি। কোনো কথা ভালো লাগলে সেটা সারাদিন মাথায় গানের মতো ঘুরপাক খায়। কি অসাধারণ একটা লাইন। "তুমি নিজেরে নিঃস্ব ভেবো না, আবার অহংকারী হয়ে নিজেরে সবকিছু ভেবে বসো না। এমন একজন মনে করো শুধু নিজেকে, যে এখন হয়ত কিছু না, কিন্তু চেষ্টা করলেই অনেক কিছু অর্জন করতে পারবে।" এখনো এই লাইনটা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন